আশির দশকে সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ বেড়ে উঠেছিল আশায়, ভালোবাসায়। রঙের মেলায়। তখন শিক্ষার হার ছিল কম। তার চেয়েও কম ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেক দূরে হেঁটে স্কুল করতে যাওয়া আমদের মতো শিশু-কিশোর আর তরুণরা ছিল একই গাছে ফুটে থাকা নানা রঙের ফুল। বাংলাদেশ নামক সে গাছে চড়ে র্ধম, গোত্র, ধনী আর গরিবের পার্থক্য করতে আমরা শিখিনি। সবাই বাংলাদেশি। সবাই আমরা এক। আমরা সবাই একসঙ্গে বুকে হাত রেখে সুর করে গাইতাম আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। একে অপরকে ভালোবাসবার প্রত্যয় নিয়ে একসঙ্গে স্যালুট করতাম জাতীয় পতাকাকে। একই পতাকার নিচে বসবাস করবার সে প্রত্যয়ে দৃঢ় থাকতাম আমরা। শিশু বাংলাদেশ তখন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার ছিল। আমরা ছিলাম বাংলাদেশ নামক গাছের নানা রঙে ফুটে থাকা রঙিন ফুল। তাই তো হিন্দুদের বাড়িতেও আমরা মুসলিমরা পূজা দেখতে যেতাম দল ধরে। আবার আমাদের ঈদে হিন্দুরাও আসত সংকোচহীন হয়েই। সে সময়ের উৎসব ছিল সত্যিকারী আনন্দের। আমরা আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতাম সে সব র্ধমীয়, সামাজিক উৎসব।
একে অপরের উৎসবে যোগ দিয়েও মেনে চলতাম অলিখিত কিছু নিয়ম। নিয়ম মেনে চলাতে আমরা খুশি হতাম। সুখী হতাম। হিন্দুদের রান্নাঘরে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। আর আমাদের মসজিদে ছিল না ওদের প্রবেশাধিকার। এ নিয়ম কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমরা মেনে নিতাম। মনে নিতাম। সীমা অতিক্রম করার চিন্তু তাই মাথায় আসত না। পূজামণ্ডবে কোরআন রেখে আসবার কিংবা হিন্দুদের মসজিদে ঢুকে পড়ার চিন্তা তাই অকল্পনীয় ছিল আমাদের কাছে। আমাদের কল্পনাসীমায় অধিকার ডিঙানোর নয়, অধিকার ধরে রাখার সৌন্দর্য ছিল। শিশুদের মতো কোমল ছিল বাংলাদেশের হৃদয়। আর তাই বলছি, শিশু বাংলাদেশ ভালো ছিল। তরুণ বাংলাদেশ দিক হারানোর আগে লাগাম টেনে ধরার আকুলতা রাখছি।
শিশুবেলায় বিদ্যুৎ না থাকা ঘরে আমি হারিকেনের আলোয় পড়তাম। রাস্তাঘাট ভালো না থাকায় মাঠের আইল ধরে স্কুলে যেতাম। মাথার ওপরে উড়ন্ত বিমানের গতি দেখে অবাক হতাম। বিমান আসার শব্দ পেলে একজন অন্যজনকে ডেকে আকাশে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম, বিমান দেখবার আশায়। আকাশের বিশালতায় তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম হাতের মুঠিতে আটকে যাওয়া সাইজের বিমান। কখনও কখনও দেখতে পেতামও না। কয়েক সেকেন্ড সময় পর বিমান মিলিয়ে গেলে আমাদের দৃষ্টিতে থেকে যেত বিশাল আকাশ। অসীম আকাশের সৌর্ন্দয থেকে যেত আমাদের মনে। আমরা আকাশ দেখতাম। আকাশের বিশালতায় এক আকাশের নিচে সবাই মিলিমিশে থাকবার স্বপ্ন দেখতাম। এখন আকাশে তাকিয়ে বিমান দেখতে হয় না। হাতের মুঠায় তাকিয়ে এখন বিমান চালানোর প্রক্রিয়াও দেখা যায়। এখন মন আকাশের মতো বড় হয় না। মন এখন হাতের তালুতে আটকে যাওয়া সাইজের হয়। মন এখন বোকা বাপে বন্দি হয়ে আনন্দ পায়।
আকাশ দেখা হয় না বলেই কি মনটা এখন হাতের মঠোয় পুরে রাখা যায়? স্বপ্নগুলোও কি তাই যর্থাথ নয়? ছোট স্বপ্নের মানুষ ছোট করেই নিজের গণ্ডি দেখে। পৃথিবীটাও বুঝি তাই কেবল ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাই হয়তো বিপর্যস্ত মানুষের চিৎকার হাতের তালুতে আটকে থাকে। কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। প্রতিবাদী হয় না এখন আর মানুষ। এখন মানুষের মন আটকে থাকে নিজের কেটে রাখা স্বাধীনতার ডানার নিচে। এখন আর পাখা মেলে ওড়ে না মনের পায়রা। ঘরবন্দি তাই মন। কেবল নিজে ভালো থাকাই বিশ্বায়নের এই যুগে এসে সবার আকাঙ্ক্ষা। সে আকাঙ্ক্ষায় নারী অনেক বেশি ভুক্তভোগী। নারী নিজে কিসে ভালো থাকে তা জানে না। জানে না বলেই নারী নিজেই নিজেকে রুখে দেয়। নিজেই নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেনে নেয় পরাধীনতা। সাজ আর হিজাবের বাহারি রঙে উড়ো রঙিন চশমায় নিজেকে দেখে খুশি হয়। নিজেকে বন্দি করে আনন্দ পায়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যোগ্য লড়াইয়ে নিজেকে তৈরি করতে অনীহা নারীর। তাই শৃঙ্খল পড়ে স্বেচ্ছায়। আর এ দলটাই বড়।
অল্প কিছু নারী যখন নিজের প্রতি আস্থা রেখে এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্য করার জন্য উঠে দাঁড়ায় তখন অন্য দলে থাকা নারী নিজের আরামকে হারিয়ে ফেলবার শঙ্কায় পগে। তখনই পথে নামা নারীর পথরোধ করে বসে সে। যে আরাম আর সুবিধা সে কিনে নেয় নিজের স্বাধীনতা আর প্রতিযোগিতায় অংশ না নেওয়ার নিশ্চয়তায়। এতে সুবিধাটা পায় পুরুষ। নিজের সুবিধা নিশ্চিত করতে তাই পুরুষরা কৌশল করে। পাকাপোক্ত কৌশল। ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেক সময় নারীকে আটকে রাখার সেই সব অলিখিত কৌশল খোদ ধর্মেই নেই। তবু নারী মেনে নেয় পুরুষের এসব কৌশল। মেনে নেয় পরিশ্রম ছাড়া খাবার, পরার, বিলাসিতা আর আরাম-আয়েশ করার জন্য। যদিও এর বিনিময়ে নারী ছেড়ে দেয় তার অধিকার, স্বাধীনতা আর সম্মান।
প্রতিযোগিতার ফাঁকা মাঠে তাই একলা চলে পুরুষ। স্বাধীনতা, সম্মান আর অধিকার তাই পুরুষ পায় সহজেই। আর এভাবেই সহজে জিতে যাওয়াতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে পুরুষ। হয়ে ওঠে নিজেরে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য বেপরোয়া। হয়ে ওঠে কৌশলী। এতে হাওয়া দিয়ে যায় মগজহীন কিছু নারী। তাই তো কখনও-সখনও নারীই হয়ে ওঠে নারীর পথের বাধা। নারীকে তাই লড়তে হয় পুরুষের পাশাপাশি নিজ গোত্রের বিরুদ্ধেও। যাত্রাটা তাই হয়ে ওঠে কঠিন থেকে কঠিনতর। অন্যদিকে, ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে জিতে যাওয়া পুরুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আধিপত্যে। আনন্দে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তাই কষতে থাকে যতশত কূটচাল। ধর্মের লেবাসে সেসব চাল দেওয়ার সহজ কৌশল রপ্ত করে পুরুষ তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর যুগের পর যুগ পুরুষ তাই এগিয়ে চলছে যতটা বুদ্ধিতে ততটাই কূটকৌশলে। নারীকে পেছন থেকে টেনে নামানোর ঝাণ্ডা নারীর হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে পুরুষ এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার কৌশল তাই একমুখী। একা।
আর কে না জানে, কেবল বোকার আনন্দ হয় একা। বোকা বাপের মতো একা। তাই হয়তো বোকা বাপের সামনে থাকা একা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বোকা বাপের সাইজ ছোট থেকে ছোট হচ্ছে, সেই সঙ্গে ছোট হচ্ছে মন। ছোট হচ্ছে স্বপ্ন। মানুষ এখন একা ভালো থাকার স্বপ্ন দেখে। একসঙ্গে বাঁচার, ভালো থাকার স্বপ্ন তাই হাতছাড়া। হাতে না থাকা বোকা বাপ সময়ে তাই আমরা ভালো ছিলাম। মন বড় ছিল। স্বপ্ন ছিল আকাশসম।
Posted ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ মার্চ ২০২২
America News Agency (ANA) | ANA