দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান শেষে উচ্চশিক্ষায় অনুপ্রবেশে ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ হলো অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের। করোনার দীর্ঘ সংক্রমণে জনজীবন বিপর্যস্ত। সেই ২০২০ সালে প্রথম রোগী শনাক্ত হবার পর থেকেই সব কিছু অবরুদ্ধতার কঠিন জালে আবদ্ধ হলে উন্নয়নের সূচকগুলো থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়। সেই সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের পথে অনেক কিছু খুলে দেয়া হলেও সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় পড়ে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা কার্যক্রম। তবে গত বছরের শেষ পর্যায়ে ধারণা করা হয়েছিল জেএসসি ও মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বিবেচনায় উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ পর্ব যাচাই করা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বসানো হবে। কিন্তু বহুল সংক্রমণ করোনা তার হরেক রকম বৈশিষ্ট্য রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিত্যনতুন রূপে আক্রান্ত করতে থাকলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষায় বসার শেষ আশাটুকু আর অবশিষ্ট থাকেনি।
এভাবে গড়াতে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা। ৪ কোটি শিক্ষার্থী গৃহবন্দী অবস্থায় অলস আর অবসর সময় কাটালেও নতুন আর এক শিক্ষা পদ্ধতি তাদেরকে অন্য রকম পাঠদান প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত করে তোলে। ২০২০ সালের মার্চের মতো ২০২১ সালের মার্চেও নতুন করে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেলে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কোন আশার আলো দৃশ্যমান না হওয়ার দুঃসহ চিত্র সংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। অভিযোগ আসতেও দেরি হয়নি। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচককে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দেয়া হলেও শুধু শিক্ষাকে কেন অবারিত করা সম্ভব হলো না? যেখানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কারিগর এবং উদীয়মান প্রজন্মের ভবিষ্যত ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেখানে কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না? পরীক্ষা নেয়া তো পরের ব্যাপার কোনভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই খুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা তার প্রাতিষ্ঠানিক আঙিনায় নতুনভাবে ফিরে যায়।
তবে ততদিনে অনেক বিপর্যয় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠাও পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে অনেক বিদ্যালয় পুনরায় শুরু করতে না পারার অনাকাক্সিক্ষত সঙ্কটও সামনে চলে আসে। শুরুতেই বলা হয়েছে, শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়া এবং কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার দুর্ভোগও নতুন বাংলাদেশ প্রস্তুতের অনাবশ্যক অশনিসঙ্কেত। শুধু কি তাই? তথ্য প্রযুক্তির বলয়ে অনুপ্রবেশও শিশুদের জন্য খুব বেশি স্বস্তিদায়ক ছিল না। যে মুঠোফোন অবোধ শিশু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা এতদিন অভিভাবকদের সচকিত করেছে সেখানে পাঠ গ্রহণের জন্য তাদের নিবিষ্ট করাও ভিন্ন মাত্রার সঙ্কট মাথা চাড়া দেয়। পাঠ গ্রহণে মনোনিবেশ কতখানি হয়েছে তা বলা মুশকিল হলেও আসক্তি বেড়েছে অনেক সেটা নির্দ্বিধায় অনুমান করা কঠিন হয়নি। বিব্রতকর অবস্থায় শুধু শিক্ষার্থী নয়, সচেতন পিতা-মাতা ও অভিভাবকরাও পড়েছেন। আর উদীয়মান কিশোর-তরুণরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালের স্পর্শকাতর সময়গুলো কি মাত্রায় উদ্দেশ্যহীন পথে অতিবাহিত করে, তেমন শঙ্কাবহুল চিত্রও উঠে আসছে নির্দ্বিধায়, পরিস্থিতির দাবি নিয়ে। এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং সারা বাংলাদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার যোগ্য স্থপতি তারা অপরাধ জগতের নির্মম হাতছানিতে শুধু যে পথভ্রষ্ট হচ্ছে তা কিন্তু নয়, বরং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের আগামীর ভবিষ্যতকে ভিন্ন মাত্রায় আশঙ্কিত করে তুলছে। তবে স্কুল কলেজ তার প্রাতিষ্ঠানিক বলয় উন্মুক্ত করে নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে পুনরায় ফিরে যাওয়াও এক অনন্য সময়ের অভিগমন। আমরা আশান্বিত নতুন ও উদীয়মান জাতির ভবিষ্যত তাদের আগামীর পথ নির্দেশনায় নিজেদের তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সবটাই করতে একেবারে পেছনের দিকে ফিরেও তাকাবে না। অনেক সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে- নতুন সম্ভাবনাকে আর কোনভাবেই হেলাফেলায় নষ্ট করা যাবে না।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকে পিছনে ফেলতে যে মাত্রায় টিকাদান কর্মসূচী সর্বজনীন অবস্থায় নিতে সক্ষম হয়েছেন সেখানে শুধু করোনাকে জয় করা নয়, উন্নয়নের অভিগামিতাকেও অবারিত করার সুযোগ ও সৌভাগ্য ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক দ্বার উন্মোচনের আগে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও বয়স বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের টিকা গ্রহণে সাহায্য সহযোগিতা উন্মুক্ত করাও বিশেষ কার্যক্রম। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার মূল পর্বে ফিরিয়ে নিতে নিয়ামক শক্তির ভূমিকায় নামাটাও জাতির জন্য এক শুভ সঙ্কেত। তবে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করার আগে যেটা বেশি জরুরী ছিল অনুপ্রবেশের দরজা খুলে দেয়া সেটাই ইতোমধ্যে শুরু করা হয়েছে। মেধা ও মনন যাচাইয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বসাই ছিল অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের জন্য বড় কার্যক্রম।
যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শুরু করা হয়েছে। তবে লক্ষণীয়, অযথা যাত্রা পথের ভিড় থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে অহেতুক জট পাকানো বন্ধ করা হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো সামাজিক দূরত্ব মেনে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রয়োজনে ঢাকার শিক্ষার্থীরাই ঢাকায় পরীক্ষা দিতে বসেছে। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাওয়ার কারণে তাদের কোন ঝামেলাই পোহাতে হয়নি। সারাদেশে একযোগে এই প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ‘ক’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। বাকি অনুষদের বিভিন্ন ইউনিটের পরীক্ষাও নির্দিষ্ট তারিখে কোন বাধাবিঘœ ছাড়াই সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ২০২০-’২১ সালের শিক্ষাবর্ষে এই ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্বভাবে সম্পন্ন হওয়ার তথ্য সবাইকে আশ্বস্ত করেছে। আর এভাবেই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের ভর্তি পরীক্ষা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও আয়োজন করবে। তেমন প্রস্তুতিই গ্রহণ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচীও জোরকদমে এগিয়ে চলেছে। বয়স বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদেরও টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ। যা শুধু করোনামুক্ত বাংলাদেশই নয়, উদীয়মান জাতির ভবিষ্যতেরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার মহাদিকনির্দেশনা।
লেখক : সাংবাদিক
Posted ৪:২১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ অক্টোবর ২০২১
America News Agency (ANA) | ANA