সোমবার ১০ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫ কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইতিহাস কোথায় দাঁড়াবে?

মুহম্মদ ফজলুর রহমান :   |   বুধবার, ২৫ নভেম্বর ২০২০   |   প্রিন্ট   |   669 বার পঠিত

ইতিহাস কোথায় দাঁড়াবে?

ইতিহাস সবকিছুতেই একটা জায়গা করে নেয়। সবকিছু ভালো-মন্দ, পজিটিভ-নিগেটিভ, সমস্যা-সংকট এবং সমাধান, যুগের, সময়ের, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন বুকে ধারণ করে ইতিহাস। সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিচ্ছেদ-বিরহ, হাসি-কান্না সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। বলা হয়- ইতিহাস নির্মোহ, নিরপেক্ষ। সময়ের বয়ান মাত্র। ইতিহাস পঠনে সময় জানা যায়, শাসক-শাসনের ধরণ-ধারণ, চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, শাসিতের মনোভাব, অনুভব, অভিব্যক্তির ধারণা মেলে। বিকৃত-অবিকৃত সত্যাসত্যের দলিল হচ্ছে ইতিহাস।

ইতিহাসেরও সংকট আছ। ইতিহাসকেও কখনো কখনো সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। অতীতেও হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তবে বর্তমানের মতো এমন সংকট বুঝি ইতিহাসের সামনে এসে আর কখনো দাঁড়ায়নি! বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি সৃষ্টি করেছে মহাসংকট। যে সংকটে মানবজীবন এবং মানবসভ্যতা হুমকির মুখোমুখি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দাম্ভিক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসৃষ্ট এক সংকট। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, থিংক ট্যাংকের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই সংকটকে বিশ্বের সংকট বলেই গণ্য করছেন। কেননা, এখনো বিশ্বের যে কোন ঘটনার নির্ণায়ক যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব মোড়ল বলে। বিশ্বের যত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা আছে, বড় বড় দেশ আছে, যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের কথা একবার ভাবে। এমন একটা সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংকট, যখন করোনার কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে বাজারে ভ্যাকসিন আসার শুভ সংবাদ শোনা যাচ্ছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোটির অধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত এবং ১২ লাখের মতো মানুষ ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দিক থেকে শীর্ষে আমেরিকার স্থান। যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এবং এ ব্যাপারেও অভিজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষক, বিজ্ঞানীরা মনে করেন করোনায় এতো আক্রান্ত, এতো মৃত্যুর জন্য ট্রাম্পের দাম্ভিকতা, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা এবং তাঁর অবজ্ঞা-অবহেলা একগুঁয়েমী মন-মানসিকতা অনেকটাই দায়ী।

প্রেসিডন্ট ট্রাম্প প্রথম টার্ম নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজে পা রাখার পর থেকে নিজের স্বার্থ, ক্ষমতা প্রদর্শন এবং কিছু না বুঝে ‘সবজান্তা শমসের’-এর মতো আচরণ করার বাইরে দেশের কল্যাণ, মানুষের মঙ্গল এবং আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরব নিয়ে কোন ভাবনা ছিল না। সবসময় মনে হয়েছে তিনি ‘অব দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল’-এর আদর্শে বিশ্বাসী জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাসী কোন প্রেসিডেন্ট নন। তিনি সবার চোখে দুর্বিনীত একনায়ক শাসক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মোটেও ভাবতেন না যে, তাঁকে আরেক টার্ম নির্বাচিত হতে জনগণের কাছে যেতে হবে, ভোট চাইতে হবে। তিনি জনতার ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখতেন না বলে তিনি জনতার সুখ-দুঃখের সাথী না হয়ে আদালতের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাইতো নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্য আসনে বিরোধীদের কোন কথা না শুনে, অনেকটা জোর করেই একজনকে নিয়োগ দেন। অনেকেই অনেক কথা বলেন তাঁর এই নিয়োগের উদ্দেশ্য নিয়ে। আমেরিকার গৌরব-অহংকার-ঐতিহ্যের ইতিহাস তিনি জানতেন না, কিংবা জানলেও ক্ষমতার গরমে ভুলে গিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। এরমধ্যে প্রথম টার্মের বিজয়ী দ্বিতীয় টার্মে পরাজিত প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনি একাদশতম প্রেসিডেন্ট। সহজে বোঝা যায় যে, প্রথম টার্মে নাগরিকদের অনেক বেশি হতাশ করা প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর পরাজিত হওয়ার পেছনে আর কোনই কারণ নেই, পরাজিত হওয়ার একমাত্র কারণ তিনি নিজে। তাঁর আচরণ তঁঅর এক নায়ক সূলভ মনোভাব। হোয়াইট সুপ্রিমেসির অহংকারে অন্ধ ট্রাম্প তাঁর অসদাচরণ, মানুষের প্রতি অবজ্ঞা-অমর্যাদা প্রদর্শন, নারীর প্রতি অসম্মান দেখানো, অরাষ্ট্রনায়কোচিত কার্যক্রম, কালো মাুনষের প্রতি অবহেলা, বিরোধীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলা ট্রাম্পকে দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটা অসহনীয় করে তুলেছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতা, মূল্যবোধ, আদর্শ এবং তার শক্তিমত্তা, ভাবমূর্তি অনেকটা মলিন ও ক্ষুণ্ন করে। যে কারণে দেশের মানুষ তাঁকে দ্বিতীয় দফায় ভোট না দিয়ে পরাজিত করেছে। দেশের বাইরের তাঁর প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে বাইডেনের বিজয়কে স্বাগত জানানো হয়েছে।

নির্বাচনে ট্রাম্পের ভোট প্রাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করে অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে, এতোটা নিন্দিত হলে তিনি নির্বাচনে ৭ কোটির উপরে ভোট পেলেন কী করে? এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি যে, তিনি সিটিং প্রেসিডেন্ট ছাড়াও প্রার্থী ছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির, অর্থাৎ জিওপির (গ্রান্ড ওল্ড পার্টি), যাদের হাত ধরে এসেছে আমেরিকার স্বাধীনতা। প্রায় ২৪০ বছর ধরে রিপাবলিকান এবং ডেমক্র্যাটিক পার্টির মধ্যেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে আসছে। বিভিন্ন শহরতলীর নন-কলেজ শ্বেতাঙ্গরা এখনও রিপাবলিকান পার্টির কট্টর সমর্থক। তারা জিওপি ছাড়া কিছুই বুঝে না। তাই ভোটের পার্থক্য খুব বেশি হবে না, এটা ধরেই নেয়া হয়েছিল। তার পরও বাইডেন-ট্রাম্পের ভোটের পার্থক্য ৫০ লাখের উপরে। এর চেয়ে কমও হতে পারতো। তাতে ভোটের ফলাফলে তেমন একটা হেরফের হতো না। ট্রাম্পের পক্ষে বাইডেনের বিজয়কে ঠেকানো যেতো না কোনভাবেই।

আমেরিকার প্রায় আড়াইশো বছরের ইতিহাস এওতো বলে না যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হাড্ডাহাড্ডি হলেই নির্বাচনের ফলকে পরাজিত প্রার্থীকে অস্বীকার করতে হবে। সমর্থকরাতো কখনো এ ম্যানডেট দেন না যে তাদের ভোটে নির্বাচিত না হলে দেশের মধ্যে একটা সংকট সৃষ্টি করতে হবে। আমেরিকার দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যে কালিমালেপন করতে হবে। তাহলে তো গত ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন এই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এবং আরো আগে আল গোর বুশ জুনিয়ার-এর নির্বাচনে অনেক বেশি পপুলার ভোটে বিজয়ী হয়েও কেবল ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে কোন সঙ্কট সৃষ্টির পথে না গিয়ে নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে। এবং তারা নিজেদের বিজয়ের সম্ভাবনা নিয়েও পরাজয় মেনে নিয়ে দেশের আদর্শ, ভাবমূর্তি সমুন্নত রেখেছেন। এদিকে উভয় ভোটে হেরেও ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীকে যা দেখাচ্ছন, তাকে দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই স্বৈরশাসকের আচরণ বলে বিবেচনা করেন। এই আচরণকে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ বলা যাবে না। এই আচরণের সঙ্গে আমেরিকার রীতি-নীতি, দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সাংবিধানিক ব্যবস্থা, সহনশীল ও সংবেদনশীল আচরণের সঙ্গে যায় না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মানসিক গঠনটাই বুঝি এমন যে, তিনি কখনো হারতে পারেন না! ব্যর্থতা শব্দের সঙ্গেই যেন তাঁর পরিচয় নেই। তিনি সাফল্যের বরপুত্র। যে করেই হোক, তাঁকে জিততে হবে। তাঁর হাতের মুঠোয় সাফল্যকে ধরা দিতেই হবে। এ জন্য তিনি যত অসত্য কথা বলা, যত ফাঁকি দেয়া, ধোঁকা দেয়া শিখেছেন। তার দর্শন ‘মি ফার্স্ট’! আমইি প্রথম। আমিই সব। সবকিছু আমার জন্য। আমার জন্য সব প্রাপ্তি। আমার জন্য নির্বাচন। আমার জন্য বিজয়। আমার জন্য হোয়াইট হাউজ। আমার জন্য পেন্টাগন, সৈন্য-সামান্ত সব! সাফল্য তাঁর অনুগত ভৃত্য। যখন সত্যি সত্যি তিনি পরাজয়ের মুখোমুখি হন, তখন তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। দিশেহারা হয়ে পড়েন। জ্ঞান, বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন না, ভয় পান।
কিন্তু এখন তিনি যা করছেন, তা অনেকটাই প্রলাপ বকার মতো। আমেরিকার নির্বাচনী ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা গৌরব এবং সংবিধানের সঙ্গে একেবারেই বেমানান এবং দৃষ্টান্ত-রহিত। কোন সিটিং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ভোটে কারচুপি বা বৈধ-অবৈধ ভোটের অভিযোগ তুলেছেন, আমেরিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর পেছনে অন্য কোন শক্তির উস্কানি রয়েছে কিনা, একটু অনুসন্ধানের দাবি রাখে বলে মনে হয়। কেননা কেউ নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে দেশের ক্ষতি করতে চাইবেন, তা মেনে নেয়া যেতে পারে না। আরও একটি কথা মনে হয় এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, শুধু বিজয়ের জন্য যাকে-তাকে মনোনয়ন না দিয়ে, প্রার্থীর মানসিক পরিস্থিতি, দেশের অখন্ডতার জন্য ক্ষতিকর কি না- অবশ্যই বিবেচনা করা উচিৎ। তাঁর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করার পরিণতি দেশের জন্য সংকট সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত ৪ বছরের আচরণরই হচ্ছে এই ফল নির্বাচনের। ডেমক্র্যাটিক পার্টির জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসের বিজয়কে যেমন গণতন্ত্রের এবং আমেরিকার জনগণের বিজয় বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের পরাজয়কেও মার্কিনী জনগণ ও আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিজয় বলে গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচনোত্তর পাগলামী, একগুঁয়েমী এবং দাম্ভিকতাকে আমেরিকার জন্য একটা হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে প্রশ্ন ওঠে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট সুপ্রিমেসির নামে বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে আমেরিকাকে বিভক্ত করছে। এই বিভক্তির হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষা পেতে হলে সংহতি, অখণ্ডতা, ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’ এই চেতনা রক্ষা ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো স্বার্থপর কূপমন্ডুক এবং ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের হাত থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিকে উদ্ধার করতে হবে। আমেরিকার জনগণ সেই জরুরি কাজটিই করেছেন এবার ভোটের মধ্য দিয়ে।

তৃতীয় বিশ্বে নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ যে আচরণ করে থাকেন কিংবা একনায়ক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতার যে রকম প্রদর্শন করেন, কথা বলেন, ট্রাম্প এবং তার কিছু সমর্থক ঠিক সেভাবেই কথা বলছেন। যাতে তার নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিস্মিত হওয়া ছাড়া গতি নেই। যা অত্যন্ত দুঃখজনক, উদ্বেগজনক। নির্বাচনে বা যে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়-পরাজয় থাকবেই। থাকবে জয়ে আনন্দ-উল্লাস। পরাজয়ে থাকবে হতাশা-কষ্ট। কিন্তু তার জন্য সব শিক্ষা, রুচি, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে শত্রুতার পর্যায়ে নিতে হবে এবং দেশকে এক কঠিন সংকটের মুখে ঠেলে দিতে হবে, এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে পরাজয় মেনে নেয়াটাই সবাই প্রত্যাশা করেন। সেদিক থেকে বর্তমানের মানুষ ট্রাম্পকে কতটা বিশ্বাস করবে জানিনা। তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নিঃসন্দেহে ধিকৃত হবে ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’-এই চেতনাকে ধ্বংসের অভিযোগে।

সমগ্র বিশ্বে করোনা ভাইরাস এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। আমেরিকা করোনায় সর্বাধিক আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থ একটি দেশ। প্রায় দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত। মৃত্যু আড়াই লাখের মতো। করোনার দ্বিতীয় আঘাতে প্রতিদিন আগেরদিনের রেকর্ড ভঙ্গ হচ্ছে আক্রান্তের দিক থেকে। এখনও প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়াচ্ছে। অনেকেই মনে করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনাকে হাল্কা করে দেখা, দম্ভ দেখিয়ে বিজ্ঞান, বিশেষজ্ঞদের কথা অমান্য করায় করোনা অনেক বেশি আস্কারা পেয়েছে এবং মানুষকে আক্রান্ত করা ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য তাঁকে দায়ী করা হচ্ছে। তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। অনেককে আক্রান্ত হতে সহযোগিতা করেছেন বলেও অনেকে অভিযুক্ত করে থাকেন ট্রাম্পকে।

করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কার্যকর ভ্যাকসিনের সুখবর যখন মানুষের দোড়গোড়ায়, গত ৩ নভেম্বর দিনটি যখন আমেরিকার গণতন্ত্রকামী মানুষ এবং বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ও গণতন্ত্র প্রত্যাশী দেশের জন্য খুব উজ্জ্বল এবং আশা জাগানিয়া একটি দিন হতে পারতো, ট্রাম্পের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা দুনিয়াজুড়ে হতাশাকেই গভীর করে তুলেছে। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে কেবল আমেরিকানদের মধ্যেই উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায় না। সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি থাকে আমেরিকার নির্বাচন এবং তার ফলাফলের উপর। ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার সব দেশই কমবেশি আমেরিকার নির্বাচন গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করে। এর কারণ বাইডেন-হ্যারিসের বিজয় বা ট্রাম্পের পরাজয় নয়, কারণ বিশ্বজুড়ে আমেরিকার গুরুত্ব, আমেরিকার প্রভাব। আমেরিকার নির্বাচন বহির্বিশ্বে আরও অধিক গুরুত্ব বহন করার কারণ, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও এমন স্মরণীয় একটি নির্বাচন উপহার দেয়ায়। এর মধ্যদিয়ে আমেরিকার সক্ষমতা, আমেরিকার জনস্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার প্রতিভাত হয়েছে। মানুষের বিজয় সূচিত হয়েছে। মানুষের আগ্রহের কাছে, গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার কাছে করোনা পরাজিত হয়েছে এই নির্বাচনে। মানুষের আগ্রহ, মানুষের আশঙ্কা প্রতিফলিত হয়েছে নির্বাচনে ব্যালটে, আগাম ভোটে এবং ভোটের দিনে সশরীরে ভোটারদের উপস্থিতির মধ্যদিয়ে। এবার রেকর্ড সংখ্যক, প্রায় ২০ কোটি ভোটার ভোট দিয়েছেন। আমেরিকার পক্ষেই এ রকম একটি ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। আমেরিকাকে অভিনন্দন, আমেরিকার মানুষকে অভিনন্দন করোনার বিরুদ্ধে মানুষের এই সংকল্পের জন্য।

ইতিমধ্যে রিপাবলিকান পার্টির অনেক সিনেটর, হাউজ সদস্য এবং অন্যান্য নেতা বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যার মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ জুনিয়র, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনী অন্যতম। আশা করি সময়ের সাথে সাথে ট্রাম্পসহ অন্যরাও বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাবেন। এ কথা ঠিক যে, ট্রাম্প এই পরাজয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না মানসিকভাবে। তিনি এতদিন বিশ্বাস করে এসেছেন, তার জন্মই হয়েছে বিজয়ের জন্য, সাফল্যের জন্য! অনুগতরাও তাঁকে বুঝিয়েছেন তিনি অজেয়, তিনি হারতে পারেন না! কিন্তু প্রকৃতি বড়ই নির্মম।

তবে বিজয়ী বাইডেন-হ্যারিসের জন্য মনে হয় সামনে আরও কঠিন বাস্তবতা অপেক্ষা করছে। করোনায় তছনছ হয়ে পড়েছে আমেরিকার অর্থনীতি। ছোট-বড় ব্যবসা দরুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন। করোনার দাপটও কমেনি, বরং বেড়েছে। এ রকম এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই সময় দলীয় বিভাজন আরও তীব্র, যা হতাশা এবং উদ্বেগজনক।

তবে ভরসা আমেরিকার জনগণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কার হাত দিয়ে বিচারকরা নিয়োগ পেলেন, বিচারকার্য পরিচালনার সময় মোটেও তাদের বিবেচনায় থাকে না। ন্যায়বিচার এবং সংবিধানের প্রতি শপথই তখন তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য।

বিশ্বাস করি, আমেরিকার জনগণ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি এবং ন্যায়বিচারের ঐতিহ্য বাইডেন-হ্যারিসের শক্তি হয়ে দাঁড়বে। আর দাঁড়াবে ইতিহাস। কেননা ভবিষ্যৎ এবং ইতিহাস থাকে জনগণের সমর্থনে বিজয়ী মানুষের পক্ষে, আগামীর পক্ষে। ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। থাকে আলোর পক্ষে।

অভিনন্দন বিজয় জো বাইডেন এবং কমলা হ্যাসকে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।
নিউইয়র্ক।

Facebook Comments Box

Comments

comments

Posted ১০:১৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৫ নভেম্বর ২০২০

America News Agency (ANA) |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Dhaka University Centennial & New Beginnings
(13377 বার পঠিত)
স্বামী তুমি কার?
(12815 বার পঠিত)
দল বেঁধে সৈকতে
(1379 বার পঠিত)
[abm_bangladesh_map]
Editor-in-chief :
Sayeed-Ur-Rabb
Corporate Headquarter :

44-70 21st.# 3O1, LIC. New York-11101. USA,

06463215067

americanewsagency@gmail.com

Copyright © 2019-2025Inc. America News Agency (ANA), All rights reserved.ESTD-1997