বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক ফ্যাক্টরকেই দায়ী করা হচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারে অসঙ্গতি এবং হুন্ডিতে দেশে অর্থ প্রেরণে অধিক লাভবান হওয়ার বিষয়টি অন্যতম। কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় সামনে এসেছে, যা অত্যন্ত গুরুতর এবং সেটি হচ্ছে প্রবাসীরা যেসব দেশে কাজ করছেন, সেসব দেশেই পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। এর ফলে প্রবাসীরাদের পরিবার যেমন তাদের আপনজনের প্রেরিত অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অপরদিকে রেমিট্যান্স খাতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ঘাটতি হচ্চে। খবরে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রবাসী আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে না আসার কারণ খুঁজতে গত বছরের শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। তারা সরকারকে দেওয়া তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, প্রধানত ৯টি কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠান না। এই সুযোগ নিচ্ছে হুন্ডি কারবারিরা।
সিআইডির দাবি, অর্থ পাচারকারীদের তিনটি চক্র তিন ধাপে প্রবাসী আয় হাতিয়ে নেয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের স্থানীয় কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হলেও অর্থ পাচারকারী কেউ ধরা পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ পথে বছরজুড়ে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে, তার প্রায় সমপরিমাণ বিদেশেই গায়েব করে দেওয়া হয়। সিআইডির মতে, প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রচার চালানো হচ্ছে। ‘রেমিট্যান্স যাতে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, সে জন্য সিআইডি কাজ করছে। হুন্ডি প্রতিরোধে সরকারের নজরদারি রয়েছে।’ সিআইডির প্রতিবেদন মতে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার তিনটি ধাপে হয়ে থাকে। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ পাচারকারীদের প্রথম দলটি দেশে মৌখিক চুক্তিতে এমএফএস এজেন্টদের অর্থ দেয়। বিদেশে দ্বিতীয় দলটি ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে। এরপর তারা তা জানিয়ে দেয় দেশে এমএফএস এজেন্টদের। সে অনুযায়ী প্রণোদনাসহ টাকা দেশে প্রবাসীর স্বজনের হাতে অথবা মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে পাঠিয়ে দেয়। ফলে প্রবাসীর পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না, রিজার্ভও বাড়ছে না। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোকে এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে প্রবাসী শ্রমিক ও দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। শ্রমিকেরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, তা পরবর্তী সময়ে তুলে ধরেছি। শ্রমিকেরা প্রবাসে ব্যস্ত জীবন কাটান। তাঁরা ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠানোর সময়ও পান না। এই সুযোগ নেয় হুন্ডির এজেন্টরা। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক আছে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সোয়া কোটির মতো। গত ১০ বছরে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও প্রবাস আয় দ্বিগুণ হয়নি হুন্ডির কারণে। প্রবাসীরাও জানেন না, তাঁদের পাঠানো আয় হুন্ডির চক্রে গায়েব হয়ে যাচ্ছে বিদেশেই। অনুসন্ধানে দলের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকেরা অনেক কষ্টের চাকরি করেন। তাঁরা প্রতিদিন ভোরে শহর ছেড়ে অনেক দূরে কাজে যান, রাতে ফেরেন। ছুটির দিনেও বাড়তি কাজ করেন। ব্যাংক খুঁজে টাকা পাঠানোর মতো পরিস্থিতিতে তাঁরা থাকেন না।
এই সুযোগটি নেয় হুন্ডি কারবারি চক্র। তারা শ্রমিকদের বাসায় গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে, দেশে এজেন্টরা প্রবাসীর স্বজনদের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। দ্বিতীয়ত, প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশ অবৈধ। তাঁরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে না পেরে হুন্ডির আশ্রয় নেন। তৃতীয়ত, ব্যাংক আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিলেও হুন্ডি এজেন্টরা দেয় ৬-৭ শতাংশ। চতুর্থত, শ্রমিকেরা কাজ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে পারেন না। হুন্ডিতে অর্থ পাঠালে দেশে স্বজনদেরও ব্যাংকে যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে হয় না। এ ছাড়া কোনো শ্রমিকের বেতন পাওয়ার আগেও বাড়িতে টাকার প্রয়োজন হলে হুন্ডির এজেন্টকে জানালেই তারা টাকা পাঠিয়ে দেয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ডলারের বিনিময় হার ঠিকভাবে নির্ধারণ না করা, অনুমোদিত মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা না থাকা এবং আমলাতান্ত্রিক-প্রশাসনিক জটিলতার কারণেও ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না শ্রমিকেরা। এছাড়া দেশের নব্য কোটিপতি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও অর্থ পাচারে জড়িত। ডিজিটাল যুগে অর্থ পাচার প্রতিরোধ চ্যালেঞ্জিং হলেও আশার কথা হলো সরকার পাচার ও হুন্ডি বিরোধী তৎপরতা জোরদার করেছে এবং সকলের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়ে রেমিট্যান্স প্রবাস বাড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
Posted ৯:০১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩
America News Agency (ANA) | ANA