বুধবার ১০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৭ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

দীর্ঘ আলাপচারিতায় : শহীদ কাদরী

প্রবাস কারো স্বদেশ হয় না : বাঙালি ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই

সাঈদ-উর-রব   বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০১৬ 1457
প্রবাস কারো স্বদেশ হয় না : বাঙালি ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই

নিজে বলেন বাঙালি ছাড়া তার আর কোনো পরিচয় নেই, তবে আর সবার কাছে কবি যার প্রধান পরিচয়, তিনি আমাদের প্রিয় এবং ভালোবাসার কবি শহীদ কাদরী। দীর্ঘদিন পরবাসে, তবু তার বিশ্বাসে ভাবনায়-ভালোবাসায় শুধুই বাংলাদেশ। প্রবাস কারো স্বদেশ হয় না, তাই সবুজ পাসপোর্টই তার আসল ঠিকানা। তাকে অনেকেই বলে থাকেন বিরলপ্রজ কবি। জন্ম দিয়েছেন মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ। এমন কোনো নির্মাণ নেই। না থাক, তারপরও তিনি বাংলার কাব্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, অবস্থান শিখরে। শুদ্ধতায়, চিত্রকল্পে, উপমায়, আঙ্গিকে, আধুনিকতায়-সবকিছুতে। দীর্ঘদিন কবিতা না লিখলেও তিনি বাংলা কবিতা জগতে প্রধানভাবে আলোচিত, যে কারণে অবিস্মৃত।
শহীদ কাদরী নাগরিক মানুষ এবং নাগরিক কবিও। তাই বলে স্বদেশ ভাবনায় তার কবিতা কিছুতেই লোকরস বঞ্চিত নয়। তার কবিতায় যে কারণে গোটা বাংলাদেশ শেকড়শুদ্ধ ঠাঁই পায় অন্তরে সোঁদামাটি আর শরীরে আধুনিকতার সুগন্ধি মেখে।
‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা,’ ‘উত্তরাধিকার’ এবং ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা যাই থাক, সেখানে সব মেজাজের এবং সব রসের সন্ধান মেলে। সব কবিতার কোষে কোষে প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনার মাখামাখি। তার কবিতা যেন সবুজ-শ্যামল বাংলার পুষ্পিত মানচিত্র। শহীদ কাদরীর কবিতা মানেই কূলভাঙা নদীর মতো বাঁধভাঙা মনের বয়ে চলা। তাঁর কবিতা মানেই অবারিত ফসলের ক্ষেত, ফুল-পাখি-প্রজাপতির রঙধনু রঙের বাহার। বাঙালির হৃদয় আঙ্গিনায় তার লুটোপুটি খেলা।
শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা আনন্দে আবেগে আন্দোলিত হই। অন্যধারে উজ্জীবিত হই অহঙ্কারে। কী স্বদেশের, কী বাইরের অস্থির এই সময়ে স্বস্তি ও সাহস মেলে শহীদ কাদরীর কবিতায়। তিনি কবিতা নির্মাণ থেকে এ সময়ে দূরে থাকলেও আমাদের কাব্যজগতের রোদেলা উঠোনে পা রাখতে হলে শহীদ কাদরীকে চিনতে হবেই। তাই তো তিনি সর্বাবস্থায় সদা উচ্চারিত।
শহীদ কাদরী দীর্ঘদিন কবিতা লিখছেন না কেন, সে এক বিরাট কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা কবিতাপ্রেমী বিশেষ করে কবি-অনুরাগীদের কাছে। অভিমান না অন্য কিছু, সে রহস্য গভীর এবং অনুন্মোচিত। কবি নিজে এ নিয়ে নীরব। অসুস্থ শরীর, নীরার ভালোবাসা আর শত সহ মানুষের শুভ কাএনা নিয়ে কবি এই পরবাসে বসবাস করছেন। এক সময়ের তুখোড় আড্ডাবাজ কবি এখন আর ফেলে আসা জীবন নাড়াচাড়া করতে খুব উৎসাহ বোধ করেন না। এসবের পরেও তিনি সম্প্রতি হাসপাতালের রোগশয্যা থেকে অনেক কষ্ট নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। যাকে বলা যায় সাগর ছেঁচা মুক্তো। লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর জুইস হাসপাতালের ৫৬৫ নম্বর বেডে শুয়ে তিনি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার নড়েচড়ে কষ্টকে সয়ে নিচ্ছিলেন। দম নিয়ে নিয়ে বলছিলেন, ‘খুব মিস করি বাংলাদেশকে। মিস করি বন্ধুদের, মিস করি আড্ডা আর আড্ডার সঙ্গীদের। খুব করে মনে পড়ে বিউটি বোর্ডিং, ঢাকার অলি-গলি-রাজপথ।’ কবির বিশ্বাস, ভাবনা, ভালোবাসা সবকিছু নিয়ে সেদিন প্রায় দিনভর কথা হয় কবির সঙ্গে। কবি শহীদ কাদরীর ভালোবাসার সেই উপহার তুলে ধরা হলো।
এনা: বাংলা কবিতার ভুবনে এলেন কী করে? আমরা জানি আপনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র।
শহীদ কাদরী : দেখুন, আমি একটি কথা বলিÑ আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না। আমরা যখন কলকাতায় ছিলাম, তখন মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের প্রতিটি মুসলমান এবং অমুসলমান ছেলের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া। কলকাতায় তখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে সবাইকে নেয়া হতো না। তারা দেখত একজন ছাত্রের বাবা, বাবার বাবা এসব স্কুলে পড়েছে কি না। আমার বাবা ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ পাস করেছিলেন। যে কারণে আমাকে ভর্তি করা হয়, কোনো পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। আমার একজন শিক্ষক বাবার অফিসে কাজ করতেন কেরানী হিসেবে। এক দিন আমি লাট্টু খেলছিলাম- তিনি আমাকে বললেন যে তোমার বাবা বলেছেন- সেকেন্ড স্ট্যান্ডাডে ভর্তি হতে না পারলে মেরে ফেলবে। এই কথা শুনে আমিতো শালা হাত মুখ ধুয়ে, টাই ও নটি বয় সু পরে তৈরি হলাম। বাবার কথা শুনে আমার বুক ধপড়-ধপড় করছে এবং কেঁদে কেঁদে মাকে বাবার কথা বললাম। মা আমার কথা শুনে বললেন তুই যা কিছু হবে না। পরীক্ষা হলে গিয়ে বসলাম, হলে আরো ১০-১২ জন ছেলে ছিল। মাস্টার সাহেব বাবার সাথে কী যেন বললেন, তারপরে ভর্তি হয়ে গেলাম। এ ভাবে আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। যে অর্থে শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হক ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ঐ অর্থে আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র না। তারা মেট্রিক, ইন্টারমেডিয়েট, বিএ অনার্স ইংরেজি, এমএ ইংরেজি আমি ঐ অর্থে না, আমি ন্যাচারাল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। আব্বা চাননি আমরা বাংলা পড়ি। আব্বা বলতেন ইসলামিয়াতকে নিয়ে উর্দু, নকরি- বকরি কে লিয়ে ইংরেজি, বাংলা পড়কে ওয়াক্ত লোকসান করকে কেয়া হোগা। আম্মারাতো তখন পর্দানশিন ছিলেন। আম্মা দোতালা থেকে নিচে নেমে দরজার সামনে এসে মাস্টার সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। ডেকে পাঠিয়ে বললেন ওদের মাতৃ ভাষা বাংলা, ওদেরকে বাংলাটা শেখাবেন। এরপর মাস্টার সাহেব বললেন, ঠিক আছে।
এনা: আপনি কি জানতেন একদিন কবি হবেন? আপনার নিজের ইচ্ছা কী ছিল?
শহীদ কাদরী : আমার ইচ্ছা ছিল আর্মিতে জয়েন করার। আব্বা সব সময় বলতেন আমাকে ক্যাডেট কলেজে দিয়ে দেবেন। আমি ভীষণ দুরন্ত ছিলাম। এ জন্য বলতেন আমার দ্বারা লেখাপড়া হবে না। আমার ভাই-এর ওপর আস্থা ছিল। সে পরীক্ষা টরীক্ষা দেবে। আব্বা এ জন্য বলতেন আমাকে আর্মিতে দিয়ে দেবেন, কমিশন ব্যাংক জয়েন করিয়ে দেবেন। এরপরই আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং সমস্ত প্ল্যান- প্রোগ্রাম উলট-পালট হয়ে গেল। আমাকে দেখবার কোনো লোকজন ছিল না। মাস্টার সাহেব ছিলেন। তিনিটে কিনে এনে এক পৃষ্ঠায় অ, অপর পৃষ্ঠায় আ লিখলেন। সেই দিন ছিল বৃষ্টির দিন, আমি বাংলা অক্ষরগুলো শিখতে লাগলাম। এর মধ্যে আমি চলে গেলাম বর্ধমানে আমার নানার বাড়িতে। ঐখানে ঠাকুর মার ঝুলি ও ছবি দেখে খুব পড়তে ইচ্ছে হলো এবং বানান করে করে শিখতে লাগলাম।
এনা: কত বছর বয়স থেকে আপনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন?
শহীদ কাদরী : এটা বোধ হয় ১১-১২ বছর বয়স থেকে। ১১ বছর বয়সে আমি উর্দুতেও কবিতা লিখেছি।
এনা: ও গুলো কী ছাপানো হয়েছে?
শহীদ কাদরী : পাগল নাকি, ওগুলো ছিল থার্ড কাস, ফোর্থ কাস কবিতা। তবে আমার লেখার প্রতি টেনডেন্সি ছিল। ছোট একটা একাংকিকা নাটকও লিখেছিলাম বাংলায়। নাটকটাও ছিল থার্ড কাস।
এনা: কলকাতায় কোথায় থাকতেন?
শহীদ কাদরী : আমরা তখন দিলকুশা স্ট্রিট কলকাতায় থাকতাম। আমার আব্বা লোকজনদের খুব মারধর করতেন। আর আব্বাদের সময় কোনো গেজেটেড অফিসারকে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারত না। আব্বার ট্যাক্সিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ফলওয়ালা থেকে শুরু করে সবাইকে এক কথা দুই কথার পর ধমাধম মেরে দিতেন। যেমন ধরুন আব্বা বলতেন ইয়ে বোম্বাইয়া ল্যান্ডা না, ফল ওয়ালা বলতেন জি স্যার ইয়ে বোম্বাইয়া ল্যান্ডা হে, আপ খা কে দেখিয়ে। আব্বা উঠে ধমাধম লাগিয়ে দিতেন এবং বলতেন, হামে কো শিখাতা হায় কোনছা বোম্বাইয়া ল্যান্ডা হায়, কোনছা বোম্বাইয়া ল্যান্ড নেহি হ্যায়। আমার আব্বার রাগ ছিল আগুন রাগ, অনেকটা মরিচের মতো।
এনা: কবিতার উপাদান হিসেবে মানুষ, দেশ, দর্শন, নৈতিকতা, সৌন্দর্যবোধ না প্রকৃতিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন?
শহীদ কাদরী : বস্তুতপক্ষে আমি সব বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কিন্তু আমি সজ্ঞানে কোনো একটা বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে লিখিনি বরং আমার নিসর্গের নুন কবিতায় প্রকৃতি নিয়ে হাসাহাসি আছে। এই কবিতায় আমি লিখেছি সবাই নিসর্গের নুন খেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাস পর্যন্ত। সবাই নিসর্গের নুন খেয়ে বেঁচে আছেন। আমি যখন নুন খেতে এলাম তখন ঘোমটা টাইনা খেমটা নাচ দেখাইলা। এটা কী ধরনের কথা। আমার মধ্যে একটা টেন্ডেন্সি ছিল কবিতার। বাংলা হোক, ইংরেজি হোক, ফরাসি হোক যেকোনো ভাষার কবিতারই টেন্ডেন্সি হলো লোকে যেটা সব সময় ব্যবহার করে সেটার বিরুদ্ধে লেখা। প্রতিবাদী হিসেবে, ফান হিসেবে বা অন্যভাবে লেখা। একটা ছোট কবিতায় আছে আমি তোমার জন্য কিছু কিনেছি, এখন প্রতীক্ষা করছি তোমার জন্যই অন্যান্য লোকের মতই নারী মাংসের বাজারে গিয়ে মানুষ যেভাবে অপেক্ষা করে। আমার কাছে মনে হয়েছে প্রত্যেকটা জিনিসের অন্য ভিউ থাকা উচিত এবং মাঝে মাঝে আমি সেটা করতেও পেরেছি। প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-ভাবনা তার বিপরীত চিন্তা-ভাবনা করাটা খুব ডিফিকাল্ট। আমি জানতামই না যে এ রকম একটা প্রবণতা আমার মধ্যে আছে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যখন আড্ডা মারতাম তখন তারা যা বলত তার উল্টো কথা বলে আমি তাদেরকে হাসাতাম। কবিতায় অনেক নতুন ধরনের উপাদান এসেছে। পোল্যান্ডে এক লেখকের কবিতায় এসেছে সন্ত্রাসী। সে এক জায়গায় বসে আছে এবং বোমা মারার পরিকল্পনা করছে। আসলে নতুন ধরনের মানুষ তৈরি হচ্ছে। আস্তে আস্তে সব বিষয়বস্তু বদলে যাবে। মানুষ অন্য রকম কথা বলবে। প্রকৃতির ব্যাপার ছিল যখন আমরা ধর্মপারায়ণ ছিলাম, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম এবং মনে করতাম সব কিছু ঈশ্বরের লীলা। তখন নদী যে কুলু কুলু ধ্বনিতে ভরে যায়, ভাবতাম এই কুলু কুলু ধ্বনি কোরআন তেলওয়াত করছে। গাছের পাতা যে ঝির ঝির করছে এটাকে ভাবতাম দোয়া-দরুদ পড়ছে। এই অপূর্ব সুন্দর প্রজাপতি এটা আল্লাহর শিল্প ক্ষমতার পরিচায়ক। আমরা আস্তে আস্তে প্রকৃতিকে আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এলাম। আমরা নিজেরাই প্রকৃতিকে সুন্দর করে প্রকাশ করতে লাগলাম। এক সময় প্রকৃতি ছিল লাইক এ টাইগার, এখন প্রকৃতি হচ্ছে লাইক এ ব্যাকইয়ার্ড গার্ডেন। প্রকৃতিকে রোমান্টিক কবিরা ঈশ্বরের সৌন্দর্যেরই একটি প্রকাশ হিসেবে দেখছিলেন। এখন তো আমরা তা দেখি না। এখন প্রকৃতি হচ্ছে ডেকোরেশন বা ডেকোরেটিভ পিস হয়ে গেছে। ডেকোরেশনের মধ্যে কোনো বক্তব্য থাকে না। তাই প্রকৃতি নিয়ে এখন কেউ কিছু ভাবছেও না। ভাববার কিছু নেইও।
এনা: তখন কারা আপনার বন্ধু-বান্ধব ছিলেন?
শহীদ কাদরী : তখনকার বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ছিল জাহাঙ্গীর, আমার এক বছরের বড় এক কাজিন (যিনি মারা গেছেন), বাচ্চু, সুকুমার মজুমদারসহ অনেকে। তারা কেউ সাহিত্য জগতে ছিল না, বই টই পড়ত। যেমন ধর কোনো ভদ্র লোক কী বলবেÑ যখন তার বন্ধু পতী জিজ্ঞেস করেন আপনি কবে দুধ ছাড়লেন সেকি বলবে ৫ বছর বয়সে দুধ ছেড়েছেন। বলবে না। আমি বলেছি। কেন যেন আমার ফান মনে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস সব জায়গাতেই ভিন্নতা করতে চান লেখকরা। একটা কথা বলতে পারি লেখক হয় না, জন্মাতে হয়। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল যাদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম, তারা সাহিত্য সংস্কৃতি করত না, একজন করত রাজনীতি (যুবলীগ), আরেকজন করত কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও আমি মার্কসবাদের ভক্ত ছিলাম; কিন্তু ওদের সাথে অনবরত আমি মার্কসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতাম। ওরা আমার সঙ্গে রাগারাগি করত এবং বলত কেন তুমি যেটা বিশ্বাস কর সেটার বিরুদ্ধে কথা বল এবং উল্টো বল। এখন কথা হচ্ছে আমার মধ্যে এমন একটা প্রবণতা ছিলা যেটা আমি কখনো ওভারকাম করতে পারিনি। এখনও আমি চেষ্টা করি ওভারকাম করতে। আমি সাধারণ মানুষের থাকা, খাওয়া, চিন্তা-বাসনা, আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা নিয়ে ফান করতাম। এখন আর করি না। কারণ সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষই। সাধারণ মানুষ কখনো অসাধারণ মানুষ হবে না। আমার বড় ভাই খুব ভালো ভালো ম্যাগাজিন বাসায় রাখতেন। যেমন বিলেতের এন কাউন্টার, আমেরিকার প্রসপেকটিভ, প্যারিস রিভিউ, সিডনি রিভিউ, হার্ডবাড রিভিউ, হিন্দুস্তান স্টেটসম্যান। এইগুলো পড়তাম এবং নানা কথা আমার মাথায় আসত। আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের এইগুলো পড়াতে চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া বাংলা পত্র-পত্রিকার মধ্যে হুমায়ুন কবীরের চতুরঙ্গ। হুমায়ুন কবীর ছিলেন আমার চাচার শ্যালক। কলকাতায় আমাদের বাসার পাশেই থাকতেন। তিনি কংগ্রেস করতেন। এর জন্য আব্বা তাকে খুব বকাঝকা দিতেন। আমি অনেক পরে বুঝেছি যে তিনি কেন ভারত ভাঙতে চাননি। হুমায়ুন কবীরের সেই পত্রিকা আতাউর রহমান একটি করে কপি পাঠিয়ে দিতেন। আতাউর রহমান ঐ পত্রিকায় কাজ করতেন। বুঝে না বুঝে বৃষ্টির দিনে চতুরঙ্গ নিয়ে শুয়ে পড়তাম। কোনোটা ভালো লাগত, কোনোটা ভালো লাগত না। এর মধ্যে কে যেন বলল পূর্বাসা পড়লে ভালো লাগে। যেজন্য বড় ভাইকে বললাম আমাকে পূর্বাসার গ্রাহক করে দেয়ার জন্য। তিনি আমাকে পূর্বাসার গ্রাহক করে দিলেন। ঐ সময় গোপনে ফাঁকে ফাঁকে আমি লেখার চেষ্টা করেছি এবং আমার ধারণা জন্মে ছিল, ইচ্ছে করলে যে কেউ লিখতে পারেন।
এনা: আপনার বাবা একজন সাংবাদিক ছিলেন, তাকে দেখে না অন্য কাউকে দেখে আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?
শহীদ কাদরী : না, কাউকে না। আই ডোন্ট নো। তবে একটা নিয়ম ছিল প্রতি রোববারে আব্বার প্রিয় বইগুলো আমরা দুই ভাই মিলে শেলফ থেকে নিয়ে ধুলাবালি মুছে আবার রেখে দিতাম। আব্বার প্রিয় বইগুলো তার বেড রুমের বুক শেলফে থাকত। ঐ সময় বই উল্টে-পাল্টে দেখেছি, ছবি দেখেছি। সেই থেকে হয়ত বইপ্রীতি হতে পারে। আব্বা আমাদের জন্য ওয়ান্ডারল্যান্ড কিনেছিলেন এবং আমাদের পড়তে দিয়েছিলেন। ঐগুলো পড়িনি, উল্টে-পাল্টে দেখেছি এবং লাল, নীল পেন্সিল দিয়ে ছবি-টবি এঁকেছি। এর জন্য অবশ্য মারধরও খেয়েছিলাম। এখন কোনটা যে আমাকে অনুপ্রাণিত করল তা বলতে পারব না। আমার চাচাতো ভাই আবু রুশদ মতিন উদ্দিন; তার প্রথম বই বের হলে রাজধানীতে ঝড় ওঠে। সব জায়গায় আলোচনা হতে লাগল আবু রুশদ কা কেতাব নিকলা, আবু রুশদ কা কেতাব নিকলা। এটা যে মনের মধ্যে একটু ঢেউ খেলল। আমার আরেকজন ফুফাতো ভাই ছিলেন আনিস চৌধুরী। আমরা আনসু ভাই বলতাম। তিনি সংবাদে কাজ করতেন, কলকতায় যখন ছিলেন তখন শিবকলঞ্জী কলেজে পড়তেন। ঢাকায় এসে বিএ পরীক্ষা দিয়ে সংবাদে ঢুকে পড়েন। উনার বড় ভাই কুদরত ঘানি ছিলেন চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্ট। তাদের পরিবারে আর্থিক অসুবিধা ছিল। হঠাৎ এক দিন শুনি যে আনসু ভাই বিয়ে করে ফেলেছেন। আনসু ভাই যে প্রেম করছেন, তা তিনি আমাকে বলেছেন। যদিও আনসু ভাইয়ের বয়স ২৫-২৬, আমার বয়স ১৫-১৬। আনসু ভাইয়ের গল্প তখন কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ এসব পত্রিকায়। আনসু ভাই তখন পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখা আমাকে দেখাল যা দেখে আমার খুব ভালো লাগল। সেই সময় সিলেট থেকে পর্দানশিন এক তরুণী লিখতেন। তার লেখা পড়ে তার প্রেমে পড়েন এবং তাকে চিঠি লেখা শুরু করেন। সেই চিঠিগুলো তিনি আমাকে দেখাতেন এবং আমাকে পড়াতেন। তিনি কবিতার একটি চরণ দিয়ে বলেন জীবনে সেই কাব্য লিখে যে জীবন যাকে দিলো ফাঁকি। একটা কথা বলি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা অনুতাপ থাকে, কোন কিছুর ঘাটতি থাকে। সেটাকে পূরণ করার জন্য সে বড় আর্টিস্ট হয়, পেইন্টার হয়, মিউজিশিয়ান হয়, রাইটার হয়। সে সারা জীবন ধরে অনুতাপকে, ফাটাকে, গর্তটাকে ভরে তুলতে চায়, কিন্তু কাউকে বলে না কী তার সমস্যা এই গল্পটা আমাকে শামসুর রাহমান বলেছিলেন। আমিতো আপনার প্রবলেম দেখতে পেয়েছি শামসুর রাহমান। প্রবলেমটা কী? আমি বলেছিলাম আপনার সাইজ। বেটে মানুষ। এটাকে আপনি ওভারকাম করতে চাইছেন। ফরাসি পেইন্টার তরুজলোতরেকের সাইজও ছিল ছোট। এটাকে তিনি ঘেন্না করতেন। যে কারণে তিনি ওয়ান অব গ্রেটেস্ট পেইন্টার হতে পেরেছিলেন। আনসু ভাইয়াকে ঐ মহিলা খুব আবেগ দিয়ে খুব সুন্দর চিঠি লিখতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আনসু ভাইয়া বেতার বাংলায় নিউজ এডিটর হয়ে এলেন। ঐখানে তখন আমার এক বন্ধুর বউ কাজ করত। আর্মি ছিল চতুর্দিকে। আমার বন্ধু বলল আনিস সাহেবতো তোর ভাই হয়, তাকে বল না, মহিলাটিকে ফায়ার করতে। আমি গেলাম এবং আনসু ভাইয়ের বউকে আমি প্রথম দেখলাম। আমাকে দেখেই আনসু ভাইয়ের বউ প্রচ- রাগ করলেন। তুমি এত দিন পর এখানে এলে তাও তোমার দরকারে, এত দিন তোমার ইচ্ছা হলো না। তিনি সিলেটের মহিলা। তিনি অত্যন্ত শার্প আর বুদ্ধিমান। তখন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমের একটা ব্যাপার ছিল। একটা কথা বলি তখন মুসলমান ছেলেরা খুব ভালো করে কোরআন তেলওয়াত করতে শিখত। তখন আমাদের দেশের বুড়া-বুড়িরা তেমন কিছু বুঝত না। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে বলত অমুক কোরআন তেলওয়াত করবে। একবার বলা হলো এনায়েত আজ কোরআন তেলওয়াত করবে। এনায়েতের চোখতো চাচীর মেয়েদের ওপরে। চাচীর মেয়েরাতো পর্দানশিন ঘরের মধ্যে। আর এনায়েত তো বাইরে বারান্দার মধ্যে কোরআন তেলওয়াত দিয়ে প্রেম করার চেষ্টা করত। এটা রশীদ করিমের বই উত্তম পুরুষে আছে। দি থিং ইউস টু হ্যাপেন। আমরা চেষ্টা করতাম মেয়েদের দেখতে। দেখতে পেতাম হয়ত পায়ের একটা ঝলক। এই আশা আমাদের ছিল যে কবিতা লিখে মেয়েদের পটানো যাবে। মেয়েরা কবিতা পড়বে এ আশাও আমরা করিনি। যাকে প্রথম দেখলাম কবিতা লিখে মহিলার সঙ্গে প্রেম করলেন, তিনি হলেন শামসুর রাহমান। আর প্রেম করলেন কার সঙ্গে- নাট্যকার সাইদ আহমেদের এমিডিয়েট বড়ভাই পেইন্টার হামিদুর রহমানের (প্রয়াত) মেয়ের সঙ্গে। হামিদুর রহমানের সাথে তার সাংঘাতিক বন্ধুত্ব ছিল। মেয়েটা ইউনিভার্সিতে পড়ত, দেখতে বেশ সুন্দর ও মিষ্টি ছিল। তার সঙ্গে শামসুর রাহমানের গভীর প্রেম হলো। প্রেমের পরে প্রপোজাল দিতে চাইলো এবং দিলো। প্রপোজাল পেয়ে মেয়ে বলল যে আমার পরিবার আমাকে সিএসপি অফিসার ছাড়া কারো সঙ্গে বিয়ে দেবে না। আমাকে যদি তোমার বিয়ে করতে হয় তাহলে তুমি সিএসপি পরীক্ষা দাও এবং বিয়ের প্রপোজাল পাঠাও, কোনো অসুবিধা হবে না। ঐ সময় শামসুর রাহমান সিএসপি পরীক্ষা দেবে কি দেবে না, এই চিন্তা করতে করতেই তার টাইফয়েড হয়ে গেল। মাথা-টাথা কামিয়ে বেহাল অবস্থা। আমি তো সব সময় যেতাম তার বাসায়। সে আমাকে ঘটনা বলল। সেই সময় শামসুর রাহমান টেক্স বুক কমিটিতে ছিল এবং কাস ফাইভ ও সিক্সের বই লিখছিল। আমাকে বলল তুমি লিখে দাও। আমাকে কাগজপত্র ধরিয়ে দিলো। আমি লিখে দিলাম এবং কিছু পয়সাও পেলাম। আমরা বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম যারা এই সব প্রাইভেট এফেয়ার্স কখনো কাউকে বলতাম না। এর মধ্যে আমাদের একজন বন্ধু ছিলৎ অত্যন্ত গুণী ও দুর্দান্ত রকম মেধাবী। সে তার খালার প্রেমে পড়ে গেল। খালার বিয়ের পর ডির্ভোস হয়ে গিয়েছে। আমার বন্ধু ও তার খালা ছিল সমবয়সী। আমি কোনো দিন বলব না তারা কে। এই রকম ঘটনা তখন ঘটত কারণ পৃথিবীতে দুটো জিনিস আছে নারীত্ব আর পৌরুষ। যেমন উচ্চপর্যায়ের প্রেমের উপন্যাস হলিসিনাস, হ্যারিফাক্স রেক্স-এর উপন্যাসে পাওয়া যাবে ইউ মাইট ফলস লাভ উইথ ইউর মাদার, ইউ মাইট ফলস লাভ উইথ ইউর সিস্টার। হ্যারিফাক্স রেক্স তো তার মাকে বিয়ে করলেন এবং আনন্দের সাথে সংসার করলেন। পরে যখন জানলো সে তার মাকে বিয়ে করেছে, তখন লজ্জায় শরমে সে তার দুই চোখ নষ্ট করে ফেলল। নিজেকে অন্ধ করে ফেলল। এই ঘটনা থেকে নিয়ে হ্যারিফাক্সের কমপ্লেক্স তৈরি হলো এভরি ম্যান হ্যাজ এক্সট্রিম রিফেকশন ফর দা মাদার। দিস ইজ ট্রু। সেই সময় এই সব প্রেমে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বদলিয়ারের কবিতায় আছে প্রেমিকা কন্যা-বোন, আমার কাব্য শোন। এই জিনিসটাকে ফরাসি সাহিত্যিকরা একেবারে বের করে নিয়ে এসেছে। একটা গল্প পড়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ৫০-৬০ বছর আগে কলকাতার একটি পত্রিকায়। গল্পটা ছিল চা বাগানের উপরে। চা বাগানের এক বাঙালি ম্যানেজার বারান্দায় বসে আছে। বসে সিগারেট খাচ্ছে, চা খেতে ইচ্ছে করছে। বাসায় শাঁওতাল রমণী কাজ করছে। ঐ রমণীকে বলল এক কাপ চা দেয়ার জন্য। শাঁওতাল রমণী বলল২ বাবু দুধতো নাই ঘরে। তাহলে দুধ ছাড়াই চা দাও। যখন চা নিয়ে আসে দেখে দুধের চা। একটু বিস্মিত হলো এবং চাতে একটা চুমুক দিলো। চুমুক দেয়ার পর স্বাদটা তার কাছে একটু ভিন্ন মনে হলো। চা খেতে খেতে শাঁওতাল রমণীর লাবণ্যময় শরীর তাকে এমনভাবে আকৃষ্ট করল যে শাঁওতাল রমণীকে তার কাছে নিয়ে এলো। তখন শাঁওতাল রমণী হেসে হেসে বলল বাবু তুইতো হারামি হয়ে গেলি। হারামি হলাম কেন রে? আমি তোকে আমার মাই-এর দুধ দিয়েছি চাতে। দেখ রাতের বেলায় কে মা, কে ছেলে এই সব কিছু থাকে না। এই এলিমেন্ট রয়ে গেছে বছরের পর বছর। এই এলিমেন্ট এসেছে আদিকাল থেকে। যখন একটা দলের সঙ্গে আরেকটা দলের বিয়ে হতো। তখনকার নিয়ম ছিল যখন নেতা মারা যাবে দলের, তখন নেতার বড় ছেলে সব মেয়েকে ইনহ্যারিট করবে তার স্ত্রী হিসেবে। তার মধ্যে তার মাও পড়ে। আমরা ঐ পর্যায় থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছি। বেরিয়ে এলেও আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি আমাদের মধ্যে পশুত্ব রয়ে গেছে প্রচ-ভাবে। এটার জন্য আমরা কান্নাকাটি করতে পারি, নাও পারি, ঘৃণাও করতে পারি; কিন্তু এটাই জীবনের একটি সত্য দিক। এটাকে মেনেও নিতে পারি এবং অধিকাংশ মানুষের মনেই এটার জন্য কোন বেদনা নেই, ব্যঞ্জনা নেই। কিন্তু কিছু কিছু লোক এসব পশুত্বের মধ্যে বাস করে। যেমন ডম, মুচি। এদের মধ্যে এগুলো রয়েছে। এইগুলো আমার বন্ধু- বান্ধবরা জানে। কেউ বলে, কেউ বলে না। আমাকে একদিন শামসুর রাহমান বলল শহীদ আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন। উত্তরে সে বলল স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম সঙ্গম করছি এমন এক মহিলার সঙ্গে যিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার। তিনি হলেন আমার এক ফুফু। ফুফু আমাদের অত্যন্ত আদর করেন এবং তাকে আমরা পায়ে ধরে সালাম করি। আমি তাকে বললাম নিশ্চয় ফুফু তোমাদের বাসায় বেড়াতে আসত।
এনা: কবিতায় রাজনীতির জায়গা আছে কি? থাকলে কতটা এবং তার ফর্মেটটা কী?
শহীদ কাদরী : রাজনীতির ফিক্সড কোনো ফর্মেট নেই। পৃথিবীর প্রথম থেকেই কবিতাতে রাজনীতি আছে। যে দিন থেকে মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে চাইল সেই দিন থেকেই রাজনীতি আছে।
এনা: আপনার কবিতার মধ্যে প্রেম- রাজনীতি কতটুকু আছে?
শহীদ কাদরী : আমার অনেক কবিতাতেই আছে। আমার অনেক রাজনীতির কবিতা আছে যেটা অনেকে বুঝতে পারে না। আমার উত্তরাধিকারের উত্তরাধিকার কবিতাটাও রাজনীতির। এই কবিতার স্ট্রাকচারটা হচ্ছে এই কবিতার কোনো স্লাগান নেই। এই কবিতায় আছে আমাদের উত্তরাধিকার কে? যেমন আমেরিকার সৈন্যরা কলকাতায় রেপ করে চলে গিয়েছে। কলকাতার পার্ক তখন ট্রেঞ্চ। ঐ ট্রেঞ্চে গরিব মেয়ে মানুষদের সঙ্গে সঙ্গম করছে বড় লোকের অপদার্থ ছেলেরা। কেউ কেউ জয়েট করেছে কমিউনিস্ট পার্টিতে। কেউ কেউ রাতের বেলায় পার্কে শুয়ে আছে, কম্পাসের মতো কম্পমান চোখ। এটা কেন? কারণটা হচ্ছে টোটাল কন্ডিশন অব দা কান্ট্রি। আমরা শুধু এক ধরনের কবিতাকে রাজনীতির কবিতা বলতে বা ধরতে শিখেছি। কিন্তু রাজনীতির কবিতা বহু বিচিত্র ধরনের। এতে কবিতাকে কবিতা হতে সাহায্য করে। এর ফলে কবিতা স্লোগানে পরিণত হয় না।

এনা: আপনি কবিতা এখন লিখেন না কেন? ভবিষ্যতে কী লেখবেন? আপনি কবিতা না লেখার কারণে আপনার পাঠকরা কি বঞ্চিত হচ্ছে না?
শহীদ কাদরী : আমি তো নিজেকে অত মহান মনে করি না যে আমি না হলে দেশ স্বাধীন হবে না; আমি বিদ্যাসাগর আমি না হলে দেশের লোকের বিদ্যা হবে না; আমি বঙ্কিম আমি না হলে দেশের লোকের জ্ঞান হবে না। আমার কবিতা না পড়ে কেউ বঞ্চিত হলো কী হলো না এটা চিন্তা করিনি। আমি মনে করি শামসুর রাহমান যদি না লিখেন তাহলে লোকে বঞ্চিত হবে। এ জন্য এ কথা বললাম যে একজন পাঠক হিসেবে আমি নিজে বঞ্চিত হবো। আমার কবিতা পড়ে কেউ বঞ্চিত হবে এটা আমি ভাবতে পারি না। আমি সারা দিন আড্ডা মেরে রাত ৩টায় বাসায় এসে খেতাম। তখনকার দিনে রান্না হতো ঘি দিয়ে। খাওয়ার উপরে উপরে ঘি ভাসত। ওটা দিয়ে ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে কোনো রকম খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়তাম। লিখতাম যখন বন্ধু-বান্ধবরা চাপ দিত। তারা বলত আমরা একটা ইস্যু বের করছি, আমাদের কবিতা আছে তোর একটা কবিতা থাকা দরকার। রোজই তারা কবিতার জন্য বলত। তাদের চাপে পড়ে লিখতাম। আমি স্বত:প্রণোদিত হয়ে লিখিনি।

এনা: কতটা বই লিখেছেন?
শহীদ কাদরী : তিনটা। এখন যা আছে তাতে করে ৪-৫টা বই হতে পারে। আমার যারা কোজ বন্ধু- বান্ধব তারা বলছে এ বইগুলো বের করতে। আমার একটা কথা হলো বই বেশি হতে হবে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর অন্যতম মহা-কবিদের একজন ফরাসি কবি জাঁ আঁতো রেবোর মাত্র দুটো বই। বই বেশি খুঁজতে হবে কী কারণে?

এনা: আপনি কবিতা লেখা শুরু করেছেন শামসুর রাহমানের প্রায় একই সময় থেকে। আপনাকে সেই সময়ের অন্যতম প্রধান কবি বলা হতো। এখন কবিতা না লিখলেও বাংলাদেশের কবি ও কবিতা নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন আপনাকে মাইনাস করে কথা বলা সম্ভব হয় না। রহস্যটা কী? এতে আপনার ভেতরে কেমন অনুভব করেন?
শহীদ কাদরী : আমি একই সময়ে লেখা শুরু করেছি আলাদা আলাদাভাবে। রহস্যটা হচ্ছে আমার মুখে একটু বড় কথা শুনাবে। রবীন্দ্রনাথ কি এখন লিখছেন? শেক্সপিয়ার কি এখন লিখছেন? আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না। তারপরেও বলি, লাগে না। যিনি মোনালিসার ছবি এঁকেছেন তিনি কি প্রত্যেক দিন মোনালিসার ছবি আঁকছেন? কয়েক শ বছর আগে মোনালিসা এঁকে তিনি শেষ হয়ে গিয়েছেন। এখনো মোনালিসাকে নিয়ে আলোচনা হয়। আমি সিম্পলি এখন লিখি না। আমার দু-একটা লেখা কারো কারো ভালো লাগে, পছন্দ হয়। তারা এই লেখাগুলোর কথা বলেন। আমার এখন লিখতে বা লেখার জন্য বসতে ইচ্ছে করে না, টায়ার্ড লাগে। বাসায় যখন থাকি তখন হয়ত বই পড়ি, না হয় টিভি দেখি, না হয় গান শুনি। লেখার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা ম্যাথু আর্নাডের একটা কবিতার লাইন দিয়ে বলি, তিনি লিখেছেন প্রখর রোদ্রের নিচে বসে পাথর ভাঙার চেয়েও বেশি কষ্টকর হচ্ছে কবিতা লেখা। ঐ কষ্টটা আমার করতে ইচ্ছে করে না। সমস্ত স্নায়ুর উপরে এমন চাপ পড়ে, শব্দ খুঁজে পাই না, মাথা খারাপ হয়ে যায়। সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে ফেলছি; কিন্তু শব্দ পাচ্ছি না। একটা লাইন চেঞ্জ করতে পারছি না, কোথাও ছন্দের গ-গোল হয়ে গেল তা ঠিক করতে গিয়ে কবিতা নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ঠিক না করলে লোকে বলবে হালায় লিখতে জানে না। যারা খুব গভীরভাবে গদ্যকে শিল্পে উত্তীর্ণ করতে চান তারাও এই জিনিসটা ফিল করেন। যে ভয়ে আমি গদ্যের ধারে-কাছেও যাই না। তোমার পত্রিকায় অনেক কবিতা ছাপা হয়, তারা তো কখনো বলে না, তাদের কষ্টের কথা। বোধ হয় তাদের কষ্ট হয় না। একটা কথা আছে সমর সেন যা লিখেছেন তাই পড়েছেন, যা পড়েছেন তাই লিখেছেন। অতএব, এদের কষ্টের কোনো বালাই নেই।

এনা: আপনি কী বই পড়েন?
শহীদ কাদরী : সব রকম বই আমি পড়ি। ম্যানুয়েল থেকে নিয়ে শুরু করে এভরিথিং পড়ি। আমার ধারণা হচ্ছে যাই তুমি পড়বে তা তোমার কাজে আসবে লেখার সময়।

এনা: আপনি কি ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন?
শহীদ কাদরী : এক সময় লিখেছিলাম কিন্তু সবগুলো ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি এখন মাঝে মধ্যে আমার ভাইকে বলি হাওয়া পাল্টে গিয়েছে, এখনতো বাঙালিরা সব ইংরেজিতে লিখছে। ভারতীয়রাও ইংরেজিতে লিখছে। আমাদের সময়ে ভারতীয় ইংরেজি লেখক ছিলেন আর কে নারায়ণ। আমরা তাদের লেখা পড়তাম। আমরা মনে করতাম এদের জীবন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে; কিন্তু এখনতো দেখছি অমিতাভ ঘোষ, ঝুম্পা লাহিড়ী, অরুন্ধুতি রায় এরা সব বিখ্যাত বিখ্যাত লেখক হয়ে যাচ্ছেন। এখন কোথায় তোমার দেশ, কী তোমার ভাষা, কী তোমার সংস্কৃতিÑ সবই তো অবান্তর হয়ে গেছে।

এনা: আপনি যে সকল লেখকের কথা বলেছেন তাদের বই পড়েছেন?
শহীদ কাদরী : পড়েছি। অরুন্ধুতি রায়ের মতো তো লেখকই নেই, এদেশেও নেই। তখন যদি ইংরেজি লিখতাম বা লিখতে পারতামÑ ভারতে তখন ইংরেজি পাবলিকেশন ছিল। কারণ অন্য কোনো ল্যাংগুয়েজ ছিল না। তখন কমলা দাস, রামানুজম, দি লাল-এর মতো বড় বড় লেখক ইংরেজিতে লিখেছিল কিন্তু আমরা বাঙালিরা এদেরকে দূর করে রেখেছি। এখন আর পারছি না। এখন তারা আন্তর্জাতিক ফিগার হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তাই মনের মধ্যে এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় হালায় করলামটা কী।

এনা: ইংরেজি ও বাংলা কবিতার মধ্যে আপনি কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
শহীদ কাদরী : অবশ্যই বাংলায়। কোনো বাঙালি লেখকের পক্ষে (আমার বড় ভাই ছাড়া) বাংলা পড়ে যে তৃপ্তি আসে তা ইংরেজিসহ অন্য ভাষায় আসে না। সে যত ইংরেজিই জানুক। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমি আমার বড় ভাইকে দেখলাম সে ইংরেজি পড়ে যত তৃপ্তি পায় অন্য কোনো ভাষায় পায় না। এ রকম লোক আরো আছে।

এনা: আপনার সম সাময়িক এবং পরবর্তী সময়ের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ওমর আলী, সৈয়দ শামসুল হক, আহসান হাবিব, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, সানাউল হক, শিকদার আমিনুল হকদের নিয়ে কিছু বলবেন কি?
শহীদ কাদরী : ওরা প্রত্যেকে অত্যন্ত বড় কবি। এছাড়া আর কিছু আমি বলতে পারবো না।

এনা: সবার কবিতা পড়েছেন?
শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। শেষের দিকের কবিতা পড়া হয়নি। আমিতো ১৯৭৮ সালে দেশ ছেড়ে এসেছি। দেশ ছাড়ার পূর্বে প্রত্যেকের লেখা পড়েছি।
এনা: আপনি কি কখনো গদ্য রচনা করেছেন?

শহীদ কাদরী : গদ্য রচনা করিনি। তবে কলাম লিখেছি।

এনা: বাংলাদেশের গদ্য নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
শহীদ কাদরী : বাংলাদেশের গদ্য এখন অনেক উন্নত হয়েছে।

এনা: পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা বলেন, বাংলাদেশের কবিতা ভালো, গদ্য ভালো নয় এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
শহীদ কাদরী : সেটা তারা বলতেন পঞ্চাশ দশকে। বাংলাদেশের দুর্বল দিক হচ্ছে ভালো উপন্যাস কম। কিন্তু প্রবন্ধের যে ভাষা সেটা এখনো ঠিক আছে। উপন্যাস নেই, গল্প নেই। আমাদের গল্প উপন্যাস ভালো হয়নি। প্রবন্ধ লেখকদের গদ্য উন্নত হয়েছে। তার মানে এই নয় যে প্রবন্ধ লেখকরা খুব স্বাধীন চিন্তা করে নতুন ধরনের কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু তাদের গদ্য অনেক উন্নতি হয়েছে। গদ্যের কোয়ালিটি, শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস অত্যন্ত ভালো। গল্প, উপন্যাসে পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশে পড়াশুনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের বিস্ফোরণ ঘটেছে। কুপি জ্বালিয়েও গ্রামে অনেকে লেখাপড়া করছে। একবার নরেশ গুহ বুদ্ধদেব বসুর কাছে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন আমরা ঢাকাতে বই পাঠাই এবং সেখানে নতুন লেখকদের উন্মেষ ঘটছে। বুদ্ধদেব হেসে বলেছিলেন, নরেশ যাদের পড়ার তারা ঠিকই পড়বে। আমরা ঢাকাতে পড়াশুনা করেছি। আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী। এর একটা কারণ হচ্ছে বাঙালি অত্যন্ত মেধাবী জাতি। দোষে গুণে মানুষ। দোষ আছে। কিন্তু এমন মেধাবী জাতি কিছু করতে পারবে না এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব।

এনা: বাংলাদেশে সাহিত্য জগতের অতীত, বর্তমানের অবস্থা এবং ভবিষ্যতের সম্ভবনা নিয়ে কিছু বলুন?
শহীদ কাদরী : প্রত্যেক দেশের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অবশ্যই আছে। ভবিষ্যৎ ছাড়া কোনো দেশ শিল্প-সাহিত্য নিয়ে টিকেনি। ভবিষ্যতে মানুষকে তার নিজের কথা বলতেই হবে।
এনা: আপনি দেশ ছাড়ার পর দেশের খোঁজখবর রেখেছেন কি?
শহীদ কাদরী : আমি খোঁজখবর না রাখলেও লোকজন আমাকে খোঁজখবর দিয়েছেন। ১৯৮৯-এ আমি লন্ডনে বাসায় বসে আছি। এমন সময় শামসুল হক আমাকে ফোন করলেন এবং বললেন চলে আসেন একটা সারপ্রাইজ আছে। জিজ্ঞেস করার পর বললেন হাসান হাফিজুর রহমান লন্ডনে। আমি অতি উৎসাহে একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম। তখন লন্ডনে ট্যাক্সি ছাড়া চলা মানেই মার খাবার অবস্থা। যাওয়ার পর আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে তার প্রথম বাক্যটা ছিল কাদরীই এ যে দেশ থেকে চলে এলেন কেউ আর আপনার নাম করে না। আমি বললাম, এতে তো আমার কোন প্রব্লেম নেই, এটা ধরে নিয়েই তো দেশ ছেড়েছি। আমরা যেখানে বলতাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গেলেই তার সাহিত্য ক্যারিয়ার শেষ, সেখানে আমি চলে এলাম লন্ডনে এর পর কেউ আমার নাম করবে আমি এটা আশা করি না। এটা বাঙালির মীননেস। আমাকেতো এটা বলার প্রয়োজন ছিল না। আমি তো আহত হতে পারতাম। আসলে আমাদের দেশটাই এমন। তার সাথে আড্ডা দিলাম, চা-নাস্তা খেলাম। হাসান যখন প্রেস মিনিস্টার হয়ে চলে গেল মস্কোতে, তখন হাসানও জানতো একই ঘটনা ঘটবে। এ ব্যাপারে আমাদের একটা ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভ রেখে কোনো লাভ নেই। বুদ্ধদেব যখন কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা করতেন অনিল চক্রবর্তী তখন বস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। অনিল চক্রবর্তীকে কবিতা পাঠাবার জন্য রেগুলার চিঠি লিখতেন বুদ্ধদেব। অনিল চক্রবর্তী কবিতা পাঠাতেন। ঐ কবিতা কম্পোজ করে প্রুফ দেখানোর জন্য বুদ্ধদেব আবার তা অনিল চক্রবর্তীর কাছে পাঠাতেন। কারণ লেখকরা প্রুফ দেখার সময়ও চেঞ্জ করে থাকেন। একমাত্র বদ্ধুদেবই এ কাজটি করেছিলেন। আর কেউতো এ কাজটি করেননি। আমাকে কেউ লিখতে বলেননি। কেউ যদি আমাকে চাপ দিয়ে ধরতেন তাহলে হয়ত আমি লিখতাম।
এনা: আপনার বন্ধুদের মধ্যে কি কোনো ভয় কাজ করেছিল?

শহীদ কাদরী : না। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পর্কে ছিল কনফিডেন্ট, ভয় তাদের মধ্যে কাজ করে না।

এনা: আপনাকে যে মনে রাখেনি, তার জন্য আপনি আঘাত পাননি?
শহীদ কাদরী : না। আমি কোনো আঘাত পাইনি।
এনা: আপনার কাব্য সৃষ্টিতে দেশি- বিদেশি কারো প্রভাব পড়েছে কি?
শহীদ কাদরী : পৃথিবীতে সর্ব প্রথম যিনি কবিতা লেখেন তার কবিতার উপরে কারো প্রভাব নেই। প্রভাব জিনিসটা কী? প্রভাব হচ্ছে তোমার চিন্তায় আরেকজনের গভীর চিন্তা থেকে রসদ জোগানো। আর আমরা প্রভাব বলতে বুঝি ঐ লাইনটা অমুকের। শেক্সপিয়ারের লেখার মধ্যে মার্লোর লাইন ভরা। কেউ বলে না যে শেক্সপিয়ারের উপরে মার্লোর প্রভাব আছে। প্রভাব আছে দৃষ্টিভঙ্গির। কারণ আমরা কীভাবে জীবনকে দেখেছি, আমাদের অগ্রজরা কীভাবে দেখেছেন, আমি কীভাবে দেখছি ও কতটুকু গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের প্রয়াস ছিল অরিজিনাল লেখার। কম লেখার এটা একটা কারণ। আর অন্য কারণ হলো আমি লিখে ফেলে দিতাম, নয়তো মাথায় আসলে মাথা থেকে ফেলে দিতাম। মনে করতাম দূর-চর্বিত চর্বণ করে কী লাভ।

এনা: কলকাতার ’৩০- এর কবি এবং ঢাকার ’৬০- এর কবিরা উভয় অঞ্চলে কবিতা এগিয়ে নিতে কতটা অবদান রেখেছেন?

শহীদ কাদরী : কলকাতার ৩০-এর কবির জন্ম না হলে ঢাকার ৬০-এর কবিদের জন্ম হতো না। এটাই হলো সত্যি কথা। রবীন্দ্রনাথের জন্ম না হলে-৩০ এর কবিদের জন্ম হতো না। এভাবে কবিতাকে বিচার করতে হয় না। কবিতা পড়ে তুমি স্বাদ পাচ্ছ কি না, রসদ আছে কি না, উত্তীর্ণ হয়েছে কি না এটাই হলো মোস্ট ইনপর্টেন্ট। কখনো কখনো শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেশে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। একটা কথা আছে নেচার অ্যাবজর্বস ভ্যাকুয়াম। আগুন যখন লাগে সেখানেতো চতুর্দিকে বাতাস থাকে না। বাতাস চতুর্দিক থেকে আসে। যখন শূন্যতার সৃষ্টি হয় তখন আসে। শূন্যতার মধ্য দিয়েই অনেক সময় সৃষ্টি বেগবান হয়। শূন্যতা আমাদের প্ররোচিত করে বেগবান হওয়ার জন্য। কিন্তু সর্বশেষ কথা হচ্ছে যে মানুষের মধ্যে আকাক্সক্ষা থাকে, বড় লেখক হবার বাসনা হয়, চর্চা করে। শূন্যতা যে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। শূন্যতা থাকলেই লেখকদের খুব সুবিধা হয়। লেখকরা সুস্পষ্ট দেখতে পায় যে কী ছিল, কী নেই, কী থাকা উচিত। তার মানে সেটা বুঝতে পারছে, সেই জন্য সে যে ভালো লিখবে এমনতো কোনো কথা নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা না থাকলে রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথ হতেন না। কিন্তু সুবিধাও ছিল তার। কারণ তখন বাংলা সাহিত্যে কিছু ছিল না। বাংলা সাহিত্যে এখনো বহু কিছু নেই। আমিতো দেখছি না কাউকে।

এনা: কলকাতার সাহিত্য নিয়ে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ন কী?

শহীদ কাদরী : কলকাতাতে যারা ভালো লিখছেন তারা ভালো লিখছেন। কলকাতাতে এখন যে সংখ্যক ভালো ঔপন্যাসিক আছেন সে সংখ্যক ভালো ঔপন্যাসিক তো আমাদের দেশে নেই। আমি মনে করি বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে গল্প- উপন্যাসের বড়জোর দু-তিনজন লেখক আছেন (যদিও কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন), আর কলকাতায় গল্প উপন্যাস লেখক আছেন ডজন ডজন । ওদেরকে নিম্ন দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। ওখানে অনেক লেখক জন্মেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও বড় লেখক। তিনি শিশুদের জন্য যেমন লিখছেন, সিরিয়াস লেখাও লিখছেন। কলকাতায় লেখকদের মধ্যে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দুর মতো লেখক রয়েছেন। সমরেশের লেখা শুধু সু-খদ। আমার কাছে মনে হয় কলকাতাতে আগে যে সংখ্যক ভালো কবি ছিলেন এখন নেই। কলকাতা হচ্ছে পটভূমি, কলকাতা আমাদের রসদ জোগায়, কলকাতার কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে প্রচুর জিনিস আছে, আসছে নতুন এবং প্রবীণ লেখক। সেখান থেকে আমাদের লেখকরা কিছুটা গ্রহণ করতে পারছেন, অন্যভাবে চিন্তা করতে শিখছেন।

এনা: গল্প-উপন্যাসে আমরা পিছিয়ে পড়ছি কেন?

শহীদ কাদরী : পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে যে জাতি যত ম্যাচিয়ুড হবে ততই সেই জাতির প্রবন্ধ, সমালোচনা, দর্শন উন্নত শ্রেণীর হবে। আর যে জাতি যত নতুন হবে সেই জাতির কবিতা তত বেটার হবে, তার গল্প-উপন্যাস ও প্রবন্ধ তেমন ভালো হবে না। কারণ প্রবন্ধ হচ্ছে ইন্টেলেকচ্যুয়েল জিনিস। ভালো প্রবন্ধ লিখতে হলে কান্ট, হেগেল বা দর্শন পড়তে হবে, চর্চা করতে হবে, জানতে হবে। না পড়লেতো ভালো প্রবন্ধ লেখা যাবে না। ইসলামি প্রবন্ধ লিখতে হলে ইবনে আল রাজি, ইবনে খালুস, ইবনে রুশদের লেখা পড়তে হবে। এদের না পড়লে ভালো ইসলামি প্রবন্ধ লেখা সম্ভব নয়। গদ্যে পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে আমাদের অশিক্ষা, শিক্ষার অভাব। কিন্তু কবিতা এমন জিনিস একজন লোক যদি তেমন শিক্ষিত নাও হয়, শুধু আবেগের চাপে সে ভালো কবিতা লিখতে পারে। আবেগের চাপ প্রবন্ধে চলবে না। প্রবন্ধে যুক্তি দিতে হবে, তথ্য দিতে হবে। এ জন্য ইংরেজিতে বলা হয় প্রবন্ধ হচ্ছে ল্যাংগুয়েজ অব জাস্টিস; আর কবিতা হচ্ছে ল্যাংগুয়েজ অব লাভ। যেখানে লাভ আছে সেখানে আছে আবেগ, আর যেখানে জাস্টিসের প্রশ্ন আসে সেখানে যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।

এনা: সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?

শহীদ কাদরী : আমি এটা বলতে পারবো না, কারণ বর্তমান সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আমি তো একটা বই পনের বিশ বার পড়ি। পৃথিবীতে কিছু বই আছে যেগুলো চিরকালের জন্য মানুষের মেধা মননে গৃহীত হয়ে গেছে। কিছু বই পড়তেই হবে। আমরা চিরন্তন সাহিত্য কেন বলি কারণ এইসব লেখাগুলো সারা জীবন মানুষের কাছে ভালো লাগে, ভালো লাগবে। কিছু লেখা, কিছু গল্প, কিছু উপন্যাস, কিছু প্রবন্ধ, কিছু ছবি, কিছু গান রয়েছে যেগুলো চিরন্তন। চিরন্তন সাহিত্য অবশ্যই পড়তে হবে। চিরন্তন সাহিত্য একবার পড়লে শেষ হয় না, বারবার পড়তে হয়। যতবার পড়বে ততবার আবিষ্কার হবে নতুন নতুন জিনিস। চিরন্তনী সাহিত্যের সঙ্গে আজকের সাহিত্যের কীভাবে তুলনা করা যায়। চিরন্তন তো চিরন্তন হয়ে গেছে, আজকের কোনটা চিরন্তন হবে বা হবে না তাতো আমি জানি না। অতএব, আজকের সাহিত্যের সঙ্গে অতীতের সাহিত্যের তুলনা করা চলে না বা মনে হয় না। বঙ্কিম পড়তেই হবে, বাংলা ভাষার সিরিয়াস পাঠক হতে হলে অবশ্যই বঙ্কিম চন্দ্র পড়তে হবে। তার দর্শন, তার তত্ত্ব কথা যতই ভুল মনে হোক, তাকে পড়তেই হবে। বঙ্কিম মুসলিমবিদ্বেষী হলেও তাকে পড়তে হবে। জুইসের লেখা খ্রিস্টানরাতো পড়ছে। কিসে হিংসে আর কিসে বিদ্বেষ এইগুলো সব ঝরে যায়, থেকে যায় তার কারুকর্ম, সৃষ্টিশৈলী। জীবনে আমরা অনেক দর্শন পাব, তত্ত্ব পাব যেটা আমরা গিলতে পারবো না, গিলতে হয়ত বাধ্য হবো। কথা হচ্ছে কেউ কারো চেয়ে মহৎ না, কেউ কারো চেয়ে ছোট না। নজরুল ইসলাম বড় না রবীন্দ্রনাথ বড় এটা তুলনা করা হয়। আমি মনে করি তুলনা করা নয়। কারণ নজরুলের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ওটা রবীন্দ্রনাথের ছিল না আর রবীন্দ্রনাথের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তা নজরুলের মধ্যে ছিল না। মুসলমান বলে নজরুলকে বড় কবি বলতে হবে এটা ঠিক না। মুসলমানদের বড় কবি হচ্ছে মির্জা গালিব।

এনা: ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন রবীন্দ্রনাথ। এর পর আর কোন বাঙালি কবি নোবেল পুরস্কার পাননি এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

শহীদ কাদরী : নোবেল পুরস্কারকে এত ভ্যালু দেয়া ঠিক না। নোবেল পুরস্কারের বিষয়টি হচ্ছে পলিটিক্যাল। যখন যে দেশ ফোরফ্রন্টে আসে তখন দেখা যায় ঐ দেশের লোকজনই নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। যেমন এখন তুরস্ককে নিয়ে চলছে গ-গোল। তুরস্ক ন্যাটো পাওয়ার হতে চেষ্টা করছে, ইউরোপের ইকোনমি মার্কেটে জয়েন্ট করার চেষ্টা করছে, সেই জন্য নোবেল পুরস্কার তাদের দেয়া হয়েছে। এখানে সাহিত্যের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। নোবেল প্রাইজতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাইজ না। নোবেল প্রাইজ ছাড়াওতো অন্যান্য প্রাইজ আছে। আমরা ব্রিটিশদের গোলাম ছিলাম, তাই তারা আমাদের শিখিয়েছিল নোবেল প্রাইজ ইজ এ গ্রেট প্রাইজ। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার ব্রিটিশরা এ জন্য দিয়েছিল যে যাতে তারা প্রমাণ করতে পারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতে এসে ভারতীয়দেরকে সভ্য করেছে। তার ফলাফল হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি।

এনা: কেউ একজন যদি কবিতা লিখতে চান তার জন্য আবশ্যকীয় অনুসরণীয় কোনো শর্ত আছে কি?

শহীদ কাদরী : কোনো শর্ত নেই, তবে ভালো লিখতে হবে, আকর্ষণীয় লেখা লিখতে হবে। একজন সুন্দরী মহিলার সুন্দরী হওয়ার কোনো শর্ত থাকে কি? একেক জন সুন্দরী একেক ধরনের সুন্দরী। এ রকম কোনো শর্ত নেই তাকে মূলবারের মতো হতে হবে, ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো হতে হবে। সে আরেক ধরনের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। কোনো কিছুরই কোনো শর্ত নেই।

এনা: কবিতার ব্যাকরণ এবং ব্যাকরণের কবিতা বলে অনেক কবি জটিল সব কথাবার্তা বলেন আসলে সেসব কতটা জরুরি?

শহীদ কাদরী : এখানে জটিলতার কিছু নেই। ব্যাকরণতো থাকবেই। ব্যাকরণ ছাড়াতো কিছু হয় না। ব্যাকরণ জরুরি হলেও, সব সময় জরুরি নয়। অনেকেই ব্যাকরণ ছাড়া অপূর্ব সুন্দর গদ্য লিখেছেন। সোজা কথা, কোনো নিয়মের মধ্যে কোনো কিছু বাঁধা যাবে না। ব্যাকরণ যেমন দরকার, ব্যাকরণ না হলেও চলে।

এনা: কবিতায় আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা, রিয়ালিজম এবং সাররিয়ালিজম এসব কথাবার্তা কি ঘরানা বলতে বুঝায়? যদি তা হয় তবে আপনি কোন ঘরানার?

শহীদ কাদরী : আমি কোন ঘরানার না এবং আমি এসব বিশ্বাসও করি না। আমি অল্পবয়সে আধুনিকতায় বিশ্বাস করতাম। এখন বিশ্বাস করি ভালো লেখায়। আমাদের সময় বরার্ট ফ্রস্টকে আধুনিক কবি বলা হতো না, পিএস এলিয়টকে আধুনিক কবি বলা হতো। আজকে রবার্ট ফ্রস্টকে মহা-কবি বলা হয়, এলিয়টকে বলা হয় না। আধুনিতা আবার কী? কবিতাকে কি প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে দিলেই আধুনিকতা হবে? তবে একটা জিনিস আছেÑ আধুনিক মন। যেটা পৃথিবীর সব কিছুকে প্রশ্ন করেছিল, কোনো কিছুই গ্রহণ করেনি। আধুনিক মন বিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং বিজ্ঞান কোনো কিছুই দেখামাত্র গ্রহণ করে না। সব কিছু তাকে প্রমাণ করে নিতে হয়। সেদিক থেকে আধুনিক কবিতা এবং আধুনিক মন আকাশের নক্ষত্র থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন করেছে এবং সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। আজকে আমরা বিজ্ঞানের এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি এখন বুঝতে পারছি বিজ্ঞানের দ্বারা আমরা বেশি কিছু পাব না, যা পেয়েছি পেয়েছি। পৃথিবীর প্রথম এবং শেষ উত্তরগুলো বিজ্ঞান দিতে পারেনি। যেমন রবীন্দ্রনাথের কে তুমি? উত্তর মেলেনি। এখন আমরা বিজ্ঞানোত্তর যুগে এসে দেখছি, বিজ্ঞানের উপরে আমাদের যে আস্থা ছিল সেটা নেই।

এনা: আপনার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভাবনার আয়নায় বাংলাদেশ এবং আমেরিকার রাজনীতিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শহীদ কাদরী : আমি মনে করি মানুষের পক্ষে সুষম বণ্টন ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমেরিকাতেও প্রচুর দীন-দরিদ্র লোক আছে, যারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে এবং তারা আশ্রয়কেন্দ্রে কান্না-কাটি করে, এরা কান্ত। এরা রাস্তার কোনায় কোনায় বসে থেকে সিগারেট ফুঁকে, গাঞ্জা ফুঁকে এবং রাস্তায় শুয়ে থাকে। আমেরিকাতেও প্রচ- রকম বৈষম্য আছে ধনীর সঙ্গে মধ্যবিত্তের, মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের। কোন দেশ, কোন জাতি এই সব বৈষম্য শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় না। বাংলাদেশেতো মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়। যেখাকার মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায় সেই দেশের রাজনীতি একটাই ‘ভাত দে হারামজাদা’। আমার বন্ধু রফিক আজাদের কবিতা। আর বাকি রাজনীতি ভোগাস। আমেরিকাতেই সেই অবস্থা হবে একদিন। আমেরিকার সুবিধা হচ্ছে এখানে সবাই খেতে পাচ্ছে। তারপরেও হোমলেস আছে। আমি মনে করি আমেরিকা বলি বাংলাদেশ বলি সবখানেই একটা সুষম অবস্থায় যেতে হবে। পরস্পর পরস্পর ভাই হবে। না হয় সমস্যা দিন দিন বাড়বে বৈ কমবে না।
এনা: আপনি কি সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন?
শহীদ কাদরী : সব দেশেই তো সমাজতন্ত্র আছে। আমেরিকার যে সোস্যাাল সিকিউরিটি সিস্টেম, এটাতো সমাজতন্ত্র থেকেই এসেছে। সোস্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম আসার কারণে শুরু হলো অর্থনৈতিক ক্রাইসিস। এই ক্রাইসিসের কারণে কমিউনিস্টরা আমেরিকাতে ভীষণভাবে পপুলার হয়ে যাচ্ছে। কমিউনিস্টদের এই পপুলারিটিকে থামানোর জন্য সোস্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম চালু করা হলো।
এনা: কবিতায় প্রেম কতটা জরুরি? কবিরা সবাই কি প্রেমিক? ভিলেন হন না?
শহীদ কাদরী : আমরা তো সবাই প্রেমিক। প্রেম মানেই যে নারী প্রেম এমন তো কোনো কথা নেই। যেকোনো সম্পর্কই প্রেমের সম্পর্ক। আমরা গল্পে, কবিতা বা উপন্যাসে যখন দেখাই দু’জন বন্ধুর মধ্যে বিরোধ তখন প্রেমের বিরোধই দেখাই। আমরা সব সময়ই প্রেমিক। আমরা সর্ব অর্থে প্রেমিক। আর ভিলেন তো হচ্ছে প্রাচীন আমলের ধ্যান-ধারণা। এক দল লোক আছে যারা খুব খারাপ, আরেক দল লোক আছে যারা খুব ভালো। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কোনো লোকই পুরোপুরি ভালো না, কোনো লোকই পুরোপুরি খারাপ না। আমাদের মধ্যে ভালত্বও আছে, আমাদের মধ্যে খারাপীও আছে। একজন লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা খ্রিস্ট ধর্মকে আকাশে তুলে ধরছে তারাই বস্তুতপক্ষে পাপী। তাদের চেয়ে পতিতাদের মন ভালো। আমি রাজা হয়েছি, আমি গোলাম হয়েছি, আমি সাধুসন্ত হয়েছি, আমি পাপীতাপী হয়েছি। আমরা মানুষরা সব কিছু।’
এনা: প্রবাসে কাব্য চর্চায় যারা আছেন তাদের সৃষ্টি আপনাকে কতটা আকর্ষণ করে এবং তাদের সম্ভাবনা কতটা? তাদের প্রতি আপনার কোনো টিপস আছে কি?
শহীদ কাদরী : আমি কারো কথা কিছু জানি না। ফকির ইলিয়াসের বই পড়িনি, তার ২/৩ টা কবিতা ঠিকানায় পড়েছি। প্রবাসে কোন লেখক-টেখক নেই। এখন পর্যন্ত হয়নি। ভবিষ্যতে হয়ত হবে।
এনা: প্রবাসে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে আপনি কীভাবে দেখেন এবং কোন মানে ফেলেন।
শহীদ কাদরী : কোন মানই নেই। মানুষকে বাঁচতে হয়। বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে বাঁচতে হয় তাই আমরা বাঁচার চেষ্টা করছি। আমিও তার মধ্যে বাদ পড়ি না। যখন মুজিব বিনরা নাটক করে আমিও দেখতে যাই। বাঁচার জন্য এইগুলো করতে হয়। কোনো উপায় নেই।
এনা: বিভিন্ন উদ্যোগটাকে কীভাবে দেখেন?
শহীদ কাদরী : উদ্যোগটা উদ্যোগের মতোই দেখি। তাদেরও একটা কিছু করে আত্মাঘা অনুভব করা দরকার। আমরা দেখি তাদের উদ্যোগটা কতটা সফল হয়েছে, সফল হলে আমরা প্রশংসা করি, খুশি হই। আমরা এদেরকে যদি মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করি তাহলে বলতে হবে অত্যন্ত নিম্নমানের। এত নিম্নমানের যে ও বলে আর শেষ করা যাবে না।
এনা: সুনীল গঙ্গোপধ্যায়, সমরেশ মজুমদাররা বলেন, কলকাতা এবং ঢাকার পরে বাংলা সংস্কৃতির তৃতীয় ক্ষেত্র হবে নিউইয়র্ক- আপনার মন্তব্য কী?
শহীদ কাদরী : আমি বিশ্বাস করি না। যেদিন হবে সেই দিন বিশ্বাস করবো। এগুলো তারা বলে নিউইয়র্কের লোকদের খুশি করার জন্য। তারা বছর বছর নিউইয়র্ক আসতে চান। কীভাবে তৃতীয়? একজন ভালো নাট্যকার দেখান? একজন ভালো কবি দেখান? একজন ভালো গল্পকার দেখান? একজন গল্পকার অর্ধেক গল্প লিখেছেন, একজন কবি দুই লাইন কবিতা লিখেছেন? দিলারা হাশেম, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু এরাতো প্রবাসের লেখক না, বাংলাদেশের লেখক, এরা প্রবাসে এসেছেন। প্রবাসের লেখক হচ্ছেন তারাই, যাদের জন্ম হবে প্রবাসে এবং যাদের বিষয়বস্তু হবে প্রবাস জীবন। যেমন বাংলাদেশের লেখকের বিষয়বস্তু হবে বাংলাদেশ।
এনা: নতুন প্রজন্মকে স্বদেশ-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার উপায় নিয়ে আপনার কোনো ভাবনা আছে কী?

শহীদ কাদরী : নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখা যাবে না। এক দল বেরুবে যারা আপন থেকেই স্বদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, আরেক দল হবে ফালতু আমেরিকান। আমার মতো অনেক ছেলেই ইংরেজিতে কবিতা লিখেছে কলকাতা শহরে, অনেক গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই বেরিয়েছিল, সেইগুলো কই? সব হাওয়া হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেও ইংরেজিতে কবিতা লিখেছিলাম, আমাকে তো কেউ আমার মাথার দিব্যি দেয়নি বা কসম দেয়নি। নিজের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে এটাও আমি চিন্তা করিনি। ধরে রাখার একটা উপায় ছিল লাইব্রেরি। কিন্তু কেউতো তা করেনি। ভালো বড় লাইব্রেরি যেখানে বাংলা কাসিক বই পাঠ করা যায়। বই পড়তে পড়তে এক সময় কিউরোসিটি জন্মায় দেখিতো আমাদের পূর্ব পুরুষরা কী লিখেছেন? এটা করা প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাথে যোগাযোগ করা। যেটা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ চেষ্টা করেছিল এবং করছে। একটা ছেলেকে বই পড়ানো এবং সেই বই নিয়ে আলোচনা। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জোর করে তো কাউকে রাখা যাবে না।
এনা: বিশ্বের অনেক কবিই তাদের প্রিয়তমা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আপনি নীরাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কি? না লিখলে ভবিষ্যতে লিখবেন বলে কি ভাবেন?
শহীদ কাদরী : আমি জানি না। এভাবে প্ল্যান করে কেউ লেখে না। যারা প্ল্যান করে লেখেন তারা লেখক কি না আমি জানি না। হতে পারে, নাও হতে পারে।
এনা: বিয়ের আগে প্রেম করেছেন? যদি করে থাকেন পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেই অনুভূতির কথা একটু বলবেন?
শহীদ কাদরী : নীরার সঙ্গেই আমি প্রেম করেছি। ভালোবাসার অনুভূতিতো ভালোবাসাই। এতে কোনো খাদ নেই।
এনা: এর আগে প্রেম করেছেন কী?
শহীদ কাদরী : এটার উত্তর আমার জানা নেই। প্রেম বলতে আমি বুঝি যে প্রেম কোনো অবস্থাতেই নিঃশেষিত হয় না। আন্ডার নো কন্ডিশন। এই যে বলে না মজনু। মজনু মানে দেওয়ানা। সত্যিকার প্রেম যেটা সেটাতে মানুষ দেওয়ানা হয়ে যায়। সত্যিকার প্রেম শেষ হয় না। আমি আগে ছয়টা প্রেম করেছি, ভবিষ্যতে ছয়টা প্রেম করবো এ ধরনের কথা বলাটাই একটা মূর্খতা। কারণ আমরা আমাদের মাকে ভালোবাসি। মাকে ভালোবাসার মতোই আমার প্রেম। আমার মা নেই বলে আমি অন্যের মাকে ভালোবাসবো আমার মায়ের মতো তা হবে না। আমার প্রেমিকার সঙ্গে যদি আমার প্রেম ভেঙেও যায়, প্রেমিকা যদি মারা যায়, তারপরেও আমি তাকে কন্টিনিউ ভালোবেসে যাবো এবং আমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবো না, অন্য কাউকে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। এটাই হলো শর্তহীন প্রেম। সাহিত্যে দেখা যাচ্ছে যে এক মাত্র মা’ই শর্তহীন প্রেম দিতে পারে। ছেলের যদি পা কেটে যায়, ছেলে যদি দেখতে অত্যন্ত আগলি হয়, মার কাছে কিন্তু সে আগলি না, মা তাকে ভালোবাসে, ছেলেও মাকে ভালোবাসে। সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা হচ্ছে মায়ের ভালোবাসা, মাকে ভালোবাসা। আর আমরা দুই-চার দিনের যে ভালোবাসা করি সেটা তো ভালোবাসা নয়, সেটা ইনফেচুয়েস্ট। লাভ ইজ মোর ডিপার থিং।
এনা: আপনার দৃষ্টিতে প্রেম-ভালোবাসার সেকাল আর একালের অবস্থা সম্পর্কে বলুন?
শহীদ কাদরী : এগুলোতো আমি জানি না। প্রেম- ভালোবাসার একাল-সেকাল নেই। প্রেম প্রেমই, ভালোবাসা ভালোবাসাই। সেকালে সুবিধা ছিল না, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হতো না, আর একালে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হয়। যেমন শ্রীকান্ত প্রেমে পড়লো। সেতো সারা জীবন প্রেমেই থাকল। ওকে বিয়ে করলো না। কিন্তু সে ভালোবেসে গেল। প্রেমের কোনো যতি নেই, প্রেম কখনো শেষ হয় না।
এনা: জীবনের একটি অনাকাক্সিক্ষত মুহূর্তের কথা বলবেন, যা আপনাকে কষ্ট দিয়েছে?
শহীদ কাদরী : অনাকাক্সিক্ষত মুহূর্ত হচ্ছে বিদেশে আসা। প্রচ- কষ্ট দিয়েছিল। এক ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে চলে আসি বিদেশে। আসার পর আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমি মস্ত বড় ভুল করেছি। যে ভুল আমার জীবনকে একবারে ওলট-পালট করে দিয়েছে।
এনা: আপনি এখনো কী সেই কষ্ট বয়ে বেড়ান?
শহীদ কাদরী : হ্যাঁ। বাংলাদেশ ছাড়া আমার কোনো দেশ নেই। আমেরিকা আমার কাছে কিছুই না। আমেরিকা তো আমার কাছে থার্ড কাস লাগে। আমাকে দেয়ার আমেরিকার কিছুই নেই। একটা জিনিসই আমি আমেরিকা থেকে পেয়েছিÑ সেটা হলো কিছু বই, যেটা ঢাকায় পেতাম না।
এনা: এই কষ্টের মধ্যে থেকেও আপনি কাকে মিস করেন?

শহীদ কাদরী : আমি আমার মাকে মিস করি, আমার বাবাকে মিস করি (যদিও বাবাকে বুঝার আগেই তিনি মারা গেছেন, আমার ৮ বছর বয়সে), বন্ধুদের মধ্যে শামসুর রাহমানকে মিস করি, আক্তারুজ্জমান ইলিয়াসকে মিস করি, ফজল শাহাবুদ্দিনকে মিস করি, মোটামুটি আমার সকল বন্ধুকে মিস করি যারা জীবিত আছেন এবং যারা মারা গেছেন। চটপটি খাওয়া মিস করি, ফুচকা খাওয়া মিস করি, বৃষ্টির রাতগুলোকে মিস করি, কী আমি মিস করি না গোটা বাংলাদেশকে মিস করি। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা আছে না গাছ তলায় শুয়ে শান্তিটুকু চিড়াগুড় খেয়ে তৃপ্তি। ঐ যে ট্রেন চলে যাচ্ছে মাঠের উপর দিয়ে, তাতে যে নতুন বউ মাথায় গোমটা টানছে ঐ দৃশ্য মিস করি। আমি আগেই বলেছি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হলো দেশত্যাগ করা।
এনা: তাহলে দেশে যাননি কেন?
শহীদ কাদরী : যেতে পারতাম, ঠিক যে কারণে লিখিনি সেই কারণে যাইওনি। আমার স্বভাবের মধ্যে আছে পড়ে থাকা, কিছু না করা। আমিতো আজ পর্যন্ত আমেরিকার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করিনি। গিয়ে ফরম আনতে হবে সেই জন্য যাইনি।
এনা: গ্রিন কার্ডের আবেদনের জন্য ফরম আনতে গিয়েছিলেন?
শহীদ কাদরী : না, আমি যাইনি। গ্রিন কার্ডের জন্য অন্য লোক আবেদন করেছিল। গ্রিন কার্ড যদি না পেতাম তাহলে চলে যেতাম। না পেলে ভালোই হতো। একটা কথা আমি বলতে চাই (যেটা আমার মনের মধ্যে আছে) আমি যদি আমেরিকান পাসপোর্ট নিই, তাহলে বাংলাদেশের সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। মনে হবে আমি বাংলাদেশের লোক নাÑ এটা আমি পারবো না। সেই কারণেই নিতে চাইনি। অনেকেই আমাকে বলেছিলেন। তাদের আমি বলেছি দেখো বাঙালি ছাড়াতো আমার কোনো পরিচয় নেই।
এনা: জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত?
শহীদ কাদরী : এটাতো খুব রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে গেল। আমাকেও রাজনৈতিক উত্তর দিতে হবে। আমি যে এই হাসপাতালে আছি আড়াই থেকে তিন মাস। যতক্ষণ পর্যন্ত নীরা এখানে না আসে, আমি মরে থাকি। আমি দূর থেকে যখন তার কথা শুনি, আওয়াজ পাই তখন বেঁচে উঠি। জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত হচ্ছে (যদি শুনতে আনরোমান্টিক লাগে) যে মুহূর্তে আমার অর্ধাঙ্গিনীর কণ্ঠস্বর আমার কানে ভেসে আসে। আমি নীরাকে ভালোবাসি। জীবনে একবারই আমি ভালোবেসেছি। তাকে আমি প্রচ- ভালোবাসি। শামসুর রাহমানের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন ‘লতিফ আমি হাঁটু মুডে তোমার কাছে ক্ষমা- ভিক্ষা করছি, যখন শুনলাম তুমি আর নেই, আমি তখন উন্মাদ। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেন আমি (শামসুর রাহমান) যখন দেখলাম যে, তোমার স্ত্রী তোমার বুকের উপর মাথা রেখে ক্রন্দন করছে, তখন তার সমস্ত শরীর কাঁপছে, তখন আমি তার স্তন্যের কম্পমান অবস্থান না দেখে পারিনি; আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল এবং সেই জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি। শালা লম্পট আর কাকে বলে। সত্যি আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনি একজন গ্রেট রাইটার, একজন গ্রেট পেইন্টার, একজন গ্রেট মিউজিশিয়ান হতে হলে তোমাকে লম্পট হতে হবে আই ডু নট বিলিভ দ্যাট। কলকাতাতে আমি একটা ঘটনা দর্শন করলাম। এক অপরূপা সুন্দরী মেয়ে প্রেমে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সুনীল তখন অলরেডি ম্যারিড এবং সাথীকে সুনীল অত্যন্ত ভালোবাসে। আমরা যখন অনুষ্ঠান শেষ করি তখন ঐ মেয়ে সুনীলের সাথে কথা বলছে। আমরা শুনছি। সুনীল বললোÑ তুমি আমার সঙ্গে নষ্টামি করতে পার আমি রাজি আছি; কিন্তু আমি বউ-বাচ্চা ছেড়ে তোমার কাছে আসতে পারবো না। তুমি যদি আমার সঙ্গে নষ্টামি করতে চাও তাহলে তোমাকে যে ভদ্রলোক ভালোবাসে তাকে বিয়ে কর। তার নাম হলো কবি মহিন্দ্র রায়। মহিন্দ্র দাকে বিয়ে করতে পারলে আমাদের মধ্যে আসা-যাওয়া হবে। আমি আসবো, নষ্টামি করবো। আমার খুব ঘৃণা লাগছিল। এটা আমি শামসুর রাহমানকে বলেছিলাম, মহিন্দ্র রায় একজন কবি, বন্ধু, অগ্রজ প্রতিম। তার সঙ্গে এমন ব্যবহার এবং বারবণিতা ধরনের একজন মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলো সুনীল যাতে সে বিয়ের পর ঐ মেয়ের সাথে নষ্টামি করতে পারে। আমি যখন যা চিন্তা করেছি বা যা দেখেছি তা লিখে যাই। মানুষ কত ভালো হতে পারে এটা আমরা জানি। হজরত মোহাম্মদের দৃষ্টান্ত আছে, যীশু খ্রিষ্টের দৃষ্টান্ত আছে, মুসা নবীর দৃষ্টান্ত আছে; কিন্তু মানুষ যে কত খারাপ হতে পারে এটা আমার মনে হয় লিখে রেখে যাওয়া উচিত।
এনা: শামসুর রাহমানের এই লতিফ কে?
শহীদ কাদরী : লতিফ হলো শামসুর রাহমানের ঢাকাইয়া বন্ধু।
এনা: সারা জীবন সজীবতা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
শহীদ কাদরী : সারা জীবন সজীবতা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে আমার পরামর্শটা একপেশে হবে। তুমি যে কোনো একটা বিষয়কে প্রাণে মনে ভালোবাসবে এবং সেটা চর্চা করবে। সেটা হকি খেলা হতে পারে, বই পড়া হতে পারে, গান গাওয়া হতে পারে, ছবি আঁকা হতে পারে, একটা কিছু করতে হবে এবং থাকতে হবে। আমাকে কী মৃত মনে হয়? আমি সাহিত্যের জন্য ভীষণভাবে সজীব। অনেক মানুষের অনেক রকম সজীবতা আছে। এক ধরনের মানুষ সারা জীবন সজীব থাকে, আরো টাকা কড়ি চাই। এক ধরনের মানুষ সজীব থাকে নিজের নাতিপুতি নিয়ে। সজীব থাকার জন্য গভীরভাবে একটা কিছুর প্রয়োজন আছে।

এনা: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? সেই দিনগুলোর কথা কিছু বলবেন কি?
শহীদ কাদরী : স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশেই ছিলাম। আমি কাজ করতাম এপিএন-এ (রাশিয়ান নিউজ এজেন্সি)। আবুল কালাম শাসমুদ্দিন আমাদের ম্যানেজার ছিলেন। খালেদ চৌধুরী, নিয়ামত হোসেন, শামসুদ্দিন ভাই এবং আক্তার হোসেন এপিএন-এ কাজ করতেন। আমাদের অফিসের দিকে তাক করে কামান বসানো ছিল। আমাদের অফিসের উল্টোদিকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাড়ি ছিল। আমরা অফিসে যেতাম এবং অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে যেতাম। ৯ মাস আমি কোথাও আড্ডা দিতে যাইনি।
এনা: কেন?
শহীদ কাদরী : আমার সাহসও ছিল না, ইচ্ছাও ছিল না এবং আমার বন্ধু-বান্ধবরাও আড্ডা দিচ্ছিল না। বন্ধু-বান্ধবরা বিকেল তিনটা-চারটা হলে রেক্সে যেত এবং মদ কিনে বাসায় চলে যেত ও সারা রাত জেগে মদ খেতো। আমার ওটা গ্রহণযোগ্য হয়নি, তাই বাসায় চলে যেতাম এবং চুপচাপ বসে থাকতাম অথবা বই পড়তাম, না হয় টিভি দেখতাম।
এনা: ঐ সময় লেখালেখি করেননি?
শহীদ কাদরী : না, ঐ সময় লেখালেখি করিনি। যা লেখালেখি করেছি, তা স্বাধীনতার পর। সেই সময় সব কাগজই যেন রাজাকারের কাগজে পরিণত হলো যদিও দৈনিক বাংলা ছিল, দৈনিক পাকিস্তান। দৈনিক পাকিস্তান যে ভূমিকা নিয়ে ছিল সেইগুলো নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। ভূমিকা অনুযায়ী দৈনিক পাকিস্তান পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেনি এবং তারা রিস্ক নিয়েছিল। দৈনিক পাকিস্তানের যিনি জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন আহসান আহমেদ এসক্স। তিনি উর্দু কবি ছিলেন। তার কারণে দৈনিক পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে সরকার বাড়াবাড়ি করেনি।

এনা: মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি মনে আছে কি?

শহীদ কাদরী : না, কোনো স্মৃতি মনে নেই। তবে দু-একটা বোমা ফাটার স্মৃতি মনে আছে। আমার কিছু মনে থাকে না। পরিবর্তনটা আমার কাছে মনে হয়েছে যে ক্ষমতা নিয়ে আর কোনো গ-গোল হবে না, বাংলা ভাষা নিয়ে আর কোনো গ-গোল হবে না কিন্তু দেশ যে ওভার নাইট সোসালিস্ট হয়ে যাবে এটা আমি ভাবিনি এবং বিশ্বাসও করিনি। এখন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা হবে এবং ঢাকাই হবে সমস্ত বঙ্গভূমির রাজধানী। এটা ফিল করে আমি খুব আনন্দ পেতাম।

এনা: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

শহীদ কাদরী : আমি তো জানি না। গণতন্ত্রের জন্য সবাই যুদ্ধ করছে। গণতন্ত্র হবে কি হবে না তা আমি বলতে পারছি না। আর গণতন্ত্র দিলে হবে টা কী?

এনা: সেনা শাসনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শহীদ কাদরী : সেনা শাসনে আমি বিশ্বাস করি না দুটো কারণে। প্রথম কারণ হলো যারা সেনাবাহিনী থেকে এসেছে তারা একটি জিনিসই জানে তাদের শিখানো হয় সব সমাধান বন্দুকের নল দিয়ে হবে। তারা কথায় কথায় বন্দুকের ভয় দেখাবে এটার নাম হলো সামরিক শাসন। দ্বিতীয় হচ্ছে তারা সিভিল সোসাইটিকে ঘৃণা করে। তারা আমাদের মনে করে ব্লাডি সিভিলিয়ান। সামরিক বাহিনী থেকে যারা রাজনীতিতে আসে তারা সিভিলিয়ান হতে চেষ্টা করে; কিন্তু তাতে করে শেষ রক্ষা হয় না। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই পাবলিকের উপর ডা-া ঘুরিয়ে তারা এত আনন্দ ও মজা পায় কেন?

এনা: আপনি বলেছেন, আপনার আর্মিতে যাবার বড় শখ ছিল। আপনি আর্মিতে গেলেতো একই কাজ করতেন?

শহীদ কাদরী : অবশ্যই। ছেলে বেলায় শখ ছিল আর্মিতে যাবার। ইউনিফর্ম ও কুচকাওয়াজ আমাকে আকর্ষণ করত।
এনা: এ আকর্ষণ থেকেই কী তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা লিখেছিলেন?
শহীদ কাদরী : না, ঐ আকর্ষণটা ভেঙে অন্য দিকে নিয়ে যাবার জন্য লিখেছিলাম তোমাকে অভিবাদন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে আমার একটা সংযোগ ছিল তা এই কবিতাতে আছে। সেই সংযোগকে আমি সেনাবাহিনীর সংযোগ হতে দেইনি। আমি এটাকে মানবিক সংযোগে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। আমার একটা কবিতা আছে টাকাগুলো কবে পাব? টাকা হলো আমার সোনার হরিণ চাই। এ জন্য মাঝে মাঝে বদলাতে হয়। আমি গেলে অন্য দশজন সেনাবাহিনীর লোকের মতো হতাম। সেনাবাহিনীতো হৃদয়হীন।
এনা: সেনাবাহিনীতো বারবার ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করে ক্ষমতা দখল করছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে, এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছে এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
শহীদ কাদরী : ওরাতো ডিসিপ্লিন ভাঙছে না, বলা চলে ডিসিপ্লিন রক্ষা করছে।
এনা: কীভাবে?
শহীদ কাদরী : ওরাতো নিজেরা আসেনি, তাদের নিয়ে আসা হয়েছে। জিয়াউর রহমান তাদের অসামরিক শাসনে নিয়ে এসেছিল। ওদের মূল কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা। হত্যা করার কারণ হলো তারা আর্মির একজন লোকের স্ত্রীকে অপমান করেছিল। ডালিমের স্ত্রীকে অপমান করেছিল গাজী গোলাম মোস্তফা।
এনা: এখন? এখন তো কেউ কাউকে আপমান করেনি? সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে গেল।
শহীদ কাদরী : এখন আর্মি বলবে, পৃথিবীর ইতিহাস যদি ঘেঁটে দেখ তাহলে দেখবে সব সময় সেনাবাহিনীই রাজত্ব করেছে। সেনাবাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দখল করেছে। আমাদের চেষ্টা করা উচিত এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য।

এনা: বাঙালির জাতীয় জীবনে ক্রান্তিকাল বলে একটি শব্দের বারংবার আবির্ভাব লক্ষণীয়। জাতির এই ক্রান্তিকালে সব শ্রেণিপেশার মানুষই কোন না কোনভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হয় উত্তরণের জন্য। আপনার মতো একজন শব্দকারিগরের কাছে আমার প্রশ্ন আমাদের সমাজের কবিরা এই ক্রান্তিকাল উত্তরণের জন্য কী ধরনের ভূমিকা অতীতে পালন করেছেন এবং বর্তমানে করছেন?
শহীদ কাদরী : ক্রান্তিকাল বলতে আমরা অনেক কিছু বুঝি। অর্থনীতি, সমাজনীতি, ক্ষমতা দখল করা নিয়ে সব কিছুই ক্রান্তিকালের মধ্যে পড়ে। যখনই আমদের বিপরীতমুখী লোকজনেরা ক্ষমতা দখল করে তখন ক্রান্তিকাল দেখা দেয়। কবিরা ক্রান্তিকাল সম্পর্কে কিছুই করতে পারে না। কবিরা কোনো যুগেই কিছু করতে পারেনি। কবিরা একটাই শুধু কাজ করতে পারে কবিতা লিখতে পারে। আর যদি কোন কবির ইচ্ছা হয় ক্রান্তিকাল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা, সে করবে। কিন্তু তার যদি ইচ্ছা না হয়? কবিদের কী ভূমিকা হবেÑ তা একজন কবি তৈরি করবে। কবিরা কারো কাছ থেকে শুনতে চায় না। রোম যখন জ্বলছে নীরু বাঁশি বাজাচ্ছে। ক্রান্তিকাল আমাদের কোনো দিনই কাটবে না। ক্রান্তিকাল সেই দিনই কাটবে যেদিন মানুষের ইউটোপিয়ান ড্রিম সাকসেসফুল হবে।
এনা: বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিভক্তি সম্পর্কে কিছু বলুন?
শহীদ কাদরী : দল বেঁধে ঘোরাফেরা করে, আবার দল ভেঙে যায়। বাংলাদেশে যারা দল বাঁধে এবং দল বাঁধে নাÑ সব ধরনের মানুষই সাহিত্যে আছে। দল বাঁধলেতো কিছু করার নেই। যেমন নির্মলেন্দু গুণ দল বাঁধা সত্ত্বেও ভালো লেখে। অনেকে দল বেঁধে খুব খারাপ লেখে। দল বাঁধার একটা সুবিধা হচ্ছে যে দলের যে প্রতিপত্তি থাকে সেটাকে কাজে লাগানো যায়।

এনা: আপনার দুই বন্ধু কবি শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ তাদেরকে সামনে রেখে কবিরা বিভক্ত হয়েছে এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
শহীদ কাদরী : আমি আল মাহমুদকে বুঝিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম দেখ আল মাহমুদ শামসুর রাহমান বড় কবি, ভালো কবি এটা যদি বল তার চেয়ে তুমি ছোট হয়ে যাবে না।
এনা: বিভক্তির কারণে কি সাহিত্যের ক্ষতি হয়নি?
শহীদ কাদরী : বিভক্ততো হয়েছে অনেক পরে সাহিত্যিক আদর্শ কিন্তু বিভক্ত হয়নি। আল মাহমুদ চলে গেছে ইসলামিক চেতনায়। আমি তো মনে করি না এর জন্য সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে, বরং লাভ হয়েছে, সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, ঋদ্ধ হয়েছে। আল মাহমুদের সঙ্গে যে বিভক্তি তা ছিল ব্যক্তিগত। আল মাহমুদ মনে করতেন তিনি শামসুর রাহমানের চেয়ে বড় কবি। বিভক্ত হলো যখন আল মাহমুদ ফররুখ আহমেদের লাইনে চলে গেলেন। আল মাহমুদ ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতায় নিয়ে গেলেন। সাম্প্রদায়িকতার সাথে ধর্মের তফাৎ হচ্ছে বিশ্বাসীর সঙ্গে, ব্যক্তি আত্মার সঙ্গে পরম আত্মার যোগাযোগ। আর ব্যক্তি আত্মাকে রাস্তায় টেনে এনে ঐ বেটা হিন্দু তাকে ছুরি মার এটা হলো সাম্প্রদায়িকতা। আমার ধর্ম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম এটা রাস্তায় চুঙ্গা দিয়ে বলতে পারি না। কারণ এখানে হিন্দু আছে, খ্রিস্টান আছে, বৌদ্ধ আছে, জৈন আছে। এইগুলো যখন বলবো তখন আমি সম্প্রদায়িক হয়ে গেলাম। আল মাহমুদ এখন এটা সংযত করেছে, প্রথম দিকে সে প্রচ- সাম্প্রদায়িক ছিল। এন্টি হিন্দু, এন্টি জুইস। এটাই হলো রিয়েল বিভক্তি। আল মাহমুদ যদি ধর্মভিত্তিক ভালো কবিতা লিখে থাকে সেটাতে সাহিত্যের ক্ষতি হবে কী করে? পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যের উৎস হচ্ছে ধর্মবোধ।

এনা: বিভক্তির কারণে দেখা যাচ্ছে এক পত্রিকায় এক ঘরানার কবির কবিতা ছাপা হচ্ছে, আরেক পত্রিকায় আরেক ঘরানার কবিতা ছাপা হচ্ছে এটার কারণ কী?

শহীদ কাদরী : এটাতো ঠিক না। এটা হওয়া উচিত নয়। কালিকলমওতো এখন আল মাহমুদের কবিতা ছাপছে। তিনি ধর্মকে নিয়ে কবিতা লিখেন বলে তার কবিতা ছাপা হবে না এটা ঠিক নয়।
এনা: আজকের অবস্থান থেকে পেছনপানে চাইলে কী কথা মনে পড়ে?
শহীদ কাদরী : এত হাজার হাজার কথা মনে পড়ে যে তার থেকে কোনটা বলবো? তবে বেশি মনে পড়ে আমি যদি বুঝতে পারতাম আমার মায়ের মৃত্যু হবে তাহলে আমি ঘর থেকে বের হতাম না। আমি তো বুঝতে পারিনি মা মাহমুদা খাতুন কাদরী মারা যাবেন।
এনা: প্রবাস কমিউনিটি নিয়ে কিছু বলুন?
শহীদ কাদরী : প্রবাসে মানুষ আসতে পারে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। প্রবাস কারো স্বদেশ না। একটি সত্য কথা বলবো আমাদের দেশে যারা খেতে পারে না, তাদের জন্য প্রবাস ভালো। আমার এক বন্ধু ছিল মি. হাসান। সে লন্ডনে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করত। আমরা একটা ফান্ডও তৈরি করেছিলাম। তার ঐখানে আমার নেমন্তন থাকত। সে আমাকে এক রাতে বললো চলেন আমার সঙ্গে। আমি তাকে বললাম কোথায়? সে বললো টাওয়ার হেমলেট থেকে ঘুরে আসি। ও তাজা রুই মাছ পেয়েছিল, তার স্ত্রী রান্না করছিল। রান্না হলে খাওয়া হবে। ভাবী মাছ কুটছে। আমরা বসলাম ড্রয়িং রুমে। কথা প্রসঙ্গে সে বললো সবইতো হলো, আমার ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট, সোফা সেট হলো, সুন্দর বাসা হলো; কিন্তু দেশে থাকলে তো এগুলো হতো না, পেট ভরে খেতেও পারতাম না, দেশে থাকলে আপনাদের সাথে বসতে পারতাম না, দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কারণ আমরা তো দোকানদার। দেশে থাকতে সে কাঠমিস্ত্রি ছিল। আমরা এখানে কী খাচ্ছি দেশে যে মুরগিটা খেতাম তার চেয়ে খারাপ মুরগিটা আমরা এখানে খাচ্ছি। খারাপ মাংস খাচ্ছি। এখানে এমন খাচ্ছি না যেটা দেশে খাইনি, এমন কিছু পারছি না যেটা দেশে পারিনি। একটা কথা বলা যায় হয়ত আয় করাটা সহজ হয়েছে। আমাদের দেশের গরিব সাধারণ মানুষ তাদের জন্য আমেরিকা-লন্ডন ভালো। যাদের অবস্থান ভালো ছিল তারা না এলে চলতো।
এনা: আপনি কোন ধরনের খাবার এবং পোশাক পরতে ভালোবাসতেন?
শহীদ কাদরী : যখন বয়স অল্প ছিল তখন ভাবতাম এমন পোশাক পরবো যেটা পরলে লোকে বুঝতে পারবে না আমি কবিতা লিখি। আর খাবার পছন্দ করতাম কাবাব পরাটা। খাবার আগে একটা টেট্রাসাইকিন কিনে নিতাম। কারণ জানতাম খেলেই পেটটা মোচড় দেবে।
এনা: কোন রঙ পছন্দ?
শহীদ কাদরী : ব্লু।
এনা: পছন্দের ফল?
শহীদ কাদরী : পছন্দের ফল হলো প্লাম। কলকাতায় থাকতে নাসপাতি।

এনা: অপছন্দ কী?
শহীদ কাদরী : আমার এক বন্ধু ছিল। ও ছিল স্নব যাকে বলে। ওর বাসাতে জন্মদিনের পার্টি করতো। সেই জন্মদিনে পার্টিতে স্যুট-টাই না পরলে যাওয়া যেত না। আমাদের মধ্যে যাদের স্যুট-টাই ছিলা না তাদেরকে সে নিজে স্যুট-টাই ধার দিতো; আর বলতো মহসীন পার্টিতে এটা পরে আসবি। পার্টি চলছে মহসীনের সাথে তার তর্কাতর্কি লেগে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই বলতো খোল শালা আমার স্যুট, এখনি খোল। এটা আমার পছন্দ হতো না। ববি হলো বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর ছোট ভাই আহমদ আলীর ছেলে। তাদের চা বাগান ছিল। তার এক আত্মীয় থাকে আমেরিকাতে। তার আত্মীয়কে ববি সম্পর্কে জিজ্ঞাস করার পর জানতে পারলাম যে চা বাগানের শ্রমিকরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সে নিশ্চয় শ্রমিকদের সাথে প্রচ- খারাপ ব্যবহার করেছিল। আমি মনে করি মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ববিকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সেই মহসীন নাকি ববির মৃত্যুতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছে।
এনা: আপনার শখ কী?
শহীদ কাদরী : আমার কোন শখ নেই। তবে একটা শখ ছিল আড্ডা।
এনা: কোথায় কোথায় আড্ডা মেরেছেন?
শহীদ কাদরী : ওয়ারীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মেরেছি। মধ্য রাতে পাঁচিলে বসে। ওয়ারী ছাড়ার পর আড্ডা মেরেছি সুইচিং শপে। ওয়ারী ছাড়ার পর মদ ধরেছি। বিউটি বোডিংয়ে মধ্য রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। এখানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল সাহাবুদ্দিন, সৈয়দ শামসুল হক মিলে প্রতি দিনই আড্ডা দিয়েছি। বাকিরা মাঝে মধ্যে যেতেন।
এনা: কেউ যদি ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেন তাকে কি আপনি বাংলার প্রতি বিমুখ ভাববেন?
শহীদ কাদরী : এখন আর আমি বিমুখ ভাববো না। এখন আমি মনে করি, যেকোনো ভাষায় যে কেউ সাহিত্য চর্চা করতে পারেন। ভাষার ব্যাপারে আমি আর জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি না। ভাষার কাজ হচ্ছে কমিউনিকেশন। যেকোনো ভাষাতে কমিউনিকেইট করতে পারলেই ভালো। নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্যতো অন্য ভাষার প্রয়োজন নেই। আমাদের ভাষাতো যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বিদেশি ভাষায় সমৃদ্ধি হলো পকেট সমৃদ্ধি করা। মাই ফার্স্ট লাভ একজন রাশিয়ান লেখকের বই। এর উপরে পৃথিবীতে লেখা হয় না। বাংলায় অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্তর আমার প্রথম প্রেম। এ রকম লেখা হয় না। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কৃষ্ণপক্ষ। আমরাতো এই সব বই পড়তাম আর হাউমাউ করে কাঁদতাম।

এনা: দেশ ছাড়ার কারণটা কি?
শহীদ কাদরী : দেশ ছাড়ার কারণ হচ্ছে আমার টাকা পয়সা বন্ধু-বান্ধবরা চুরি করে নিয়ে চলে গেল। তখন আমি ভাবলাম যে এদের সাথে আর সম্পর্কই রাখবো না। বাংলা ভাষার সাথেই সম্পর্ক রাখবো না, শিল্প- সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না। আমি একটা নতুন মানুষ হবো।

এনা: নতুন মানুষ হয়েছেন কি?
শহীদ কাদরী: না, হইনি।
এনা: কোনটা ভালো ছিল?
শহীদ কাদরী: কোনটাই ভালো ছিল না। একটাতে কষ্ট ছিল, অন্যটাতে কষ্ট ছিল না। আমি আমার সমস্ত জীবন দিয়ে বুঝলাম যে আমাদের সত্যিকারের পরিচয় ফেলে দিয়ে নতুন পরিচয়ে মানুষ হতে পারি না। সৈয়দ শামসুল হকের বাল্যকালের একটি কবিতা আছে ‘২৩ ধরে বদলি হলাম বদলাতে পারিনি হৃদয়।’ আমরা যা আমরা তাই। আমরা আমাদের মধ্যে মারামারি করবো, কাটাকাটি করবো, একজন আরেকজনকে পছন্দ করবো না, দলাদলি করবো, সব কিছু করবো তারপরেও এরাই আমাদের সব। এরাই আমাদের প্রেম, ভালোবাসা। এরাই আমাদের ভালোবাসা। আমরা বাংলাদেশের লোক সেটাই বড় কথা।
এনা: আগামীতে লিখবেন কি?
শহীদ কাদরী : এখনো আমার লেখার ইচ্ছে করে। এটা আমি আমার স্ত্রী নীরাকে বলেছি। কিন্তু জানি না পারবো কি না।
এনা: আপনি লন্ডন কতদিন ছিলেন?
শহীদ কাদরী : আমি পাঁচ বছর লন্ডনে ছিলাম এবং জার্মানিতে তিন মাসের মতো ছিলাম। এখন মনে হয় লন্ডনটা আমার জন্য বেটার ছিল। কারণ লন্ডনের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট অব স্টাডিজ-এ ৩০ হাজার বাংলা বই ছিল। তখন মাথার মধ্যে একটা ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মর্ডান দেশ হচ্ছে আমেরিকা। আমেরিকা দেখা না হলে আধুনিক পৃথিবী দেখা হবে না এই সব ভুল-ভ্রান্তি মাথার মধ্যে ছিল।
এনা: খেলাধুলা করেছেন কি?
শহীদ কাদরী : আমি ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, বেইস বল সব কিছুই খেলতাম। অন্য লোকের বাড়ির দরজা জানালা ভেঙে দিতাম। রাতের বেলায় আমরা এয়ার গান নিয়ে বের হতাম। আমি, শামীম, ববি, সালেদী ডেসট্রাকটিভ ছিলাম। দুষ্টতো ছিলামই। দমাদম মেরে দিতাম। সিগারেট খাওয়ার জন্য কলকাতা শহর থেকে বেরিয়ে যেতাম। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বিনা পয়সায় ট্রেনে চড়তাম। ববির হিসাব করা ছিল যে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত টিটি আমাদের বগিতে আসবে না। আমরা একেবারে শেষের বগিতে উঠতাম। টিটি আসার আগেই আমরা মধ্যমগ্রামে নেমে পড়তাম।

এনা: আপনি একবার বলেছিলেন আপনি ৯ মাস বেডে ছিলেন এবং আপনাকে তওবা করানো হয়েছিল, সেই সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?
শহীদ কাদরী : প্রায় ৯ মাসের মতো অসুস্থ ছিলাম বেডে। তখন আমার বড় ভাই আমাকে তওবা করিয়েছিল। আমার ভাইতো ইসলাম ধর্মে প্রচ- রকম বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নাস্তিকতা করে তোমার ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয়নি। তুমি তওবা কর। তারপর সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেলাম।
এনা: এখন কী অবস্থা?
শহীদ কাদরী : আমি এখন দোদুল্যমান। বিপদে পড়লে সব মুসলমানের যে অবস্থা আমারও একই অবস্থা। আবার যখন ভালো হয়ে যাই তখন ভুলে যাই। আমাদেরকে শেখানো হয়েছে যে জিনিস তুমি ল্যাবরেটরিতে মাপতে পারবে না, মেজারমেন্ট করতে পারবে না, ধরতে পারবে না, ছুঁতে পারবে না, দেখতে পারবে নাÑ ওটা একজিস্ট করে না। শিখানোর কারণে যা দেখি না সেটাকে বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু এখন শুনা যাচ্ছে বিজ্ঞানে এমন কিছু আছে যা দেখা যায় না। কিন্তু বিশ্বাস করতে হয়।

এনা: সময় কাটে কীভাবে?
শহীদ কাদরী : কথা বলে। কথা বলতে আমার ভালো লাগে, মনে হয় আমি ঠিক আছি, আর কথা বলতে না পারলে মনে হয় কী হবে আমার, একটু একটু করে আমি এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। মন খারাপ হয়ে যায়Ñ মরতে তো আমরা কেউই চাই না। ‘কে যেন বলে গেল এই জীবন নরক নরক, নরক তো পিতার শিশ্ন, মায়ের জরায়ু, নরকেই পেতে চাই দীর্ঘ পরমায়ু’।
এনা: এনার পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শহীদ কাদরী : তোমাকে ও।
( বি: দ্র:) : এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি ২০০৮ সালে হাসপাতাল বেডে নেয়া হয়েছিল।

সাক্ষাৎকার
সাঈদ-উর-রব
প্রেসিডেন্ট/ এডিটর-ইন-চিফ
আমেরিকা নিউজ এজেন্সি (এনা)
নিউইয়র্ক

Facebook Comments Box

Comments

comments

Posted ৯:৫৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০১৬

America News Agency (ANA) |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

 

President/Editor-in-chief :

Sayeed-Ur-Rabb

 

Corporate Headquarter :

 44-70 21st.# 3O1, LIC. New York-11101. USA, Phone : +6463215067.

Dhaka Office :

70/B, Green Road, 1st Floor, Panthapath, Dhaka-1205, Phone : + 88-02-9665090.

E-mail : americanewsagency@gmail.com

Copyright © 2019-2024Inc. America News Agency (ANA), All rights reserved.ESTD-1997