দেখতে দেখতে রমজান শেষ হয়ে গেল। সামনে আসবে খুশীর ঈদ। রমজানের ৩০টি রোজার পর এই ঈদ মানুষের মনে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দ, ঘরে ঘরে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী ঈদ উৎসবে মেতে ওঠে। এই ঈদকে কেন্দ্র করে শুধু ঈদের দিন নয়, ঈদের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় বিশাল আয়োজন। ধনী-গরীব যে যার সাধ্য অনুযায়ী ঈদের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ঈদকে ঘিরে যে বিশাল আয়োজন চলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিশাল ভূমিকা রাখে;
তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিন্তু একেবারেই ভিন্ন, এবারে আমরা রমজানের রোজাও পালন করছি এবং সামনে ঈদও পালন করবো; তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। কারণ গত মার্চ থেকে এক ভয়ানক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলছি। এই অদৃশ্য ‘করোনা’নামের ভাইরাসটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীকেই তটস্থ করে রেখেছে। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে এই ভাইরাস তার পদচিহ্ন ফেলেনি। করোনা নামের এই ভাইরাসের কারণে পৃথিবীজুড়ে মানুষ এক ভয়াবহ আতংকিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। স্থবির হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। এই ভাইরাসকে ঘিরে এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে মানবজাতি।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো করোনাভাইরাস বাংলাদেশকেও আক্রমণ করেছে। থমকে গিয়েছে জীবনের গতি, থমকে গিয়েছে অর্থনীতির চাকা। গত ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পরে, তার পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ করোনার আক্রমণে এক অস্থির সময় পার করছে। প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে করোনা রোগী এবং দিন কে দিন এই শনাক্তের হার আশংকা জনক হারে বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর দশম সপ্তাহ শেষ হলো। দশম সপ্তাহের মেয়াদ কাল ১০ থেকে ১৬মে পর্যন্ত। অষ্টম সপ্তাহ থেকে দশম সপ্তাহে আক্রান্ত বেড়েছে তিনগুন এবং মৃত্যু বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে শনাক্তকৃত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক এবং করোনার কারণে মৃতের সংখ্যা ৩০০ এর অধিক। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ- সিজিএস এর একটি জরিপে বেরিয়ে এসেছে যে, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ৯২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের কারো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। একটি কথা সহজেই অনুমেয় যে, শনাক্তকৃত আক্রান্ত রোগীর বাইরেও হয়ত করোনা রোগী থাকতে পারে।
তবে এতো কিছুর পরও জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা যেন রামের হরধনু ভাঙার মতো পণ করেছি যে, আমরা সকল স্বাস্থ্যনীতি অবজ্ঞা করে করোনাকে জয় করেই ছাড়বো। আমরা একরকম প্রতিজ্ঞাই করেছি যে, আমরা প্রমাণ করবোই আমরা করোনার চেয়ে বেশী শক্তিশালী। কাদম্বিনীকে যেমন মরে প্রমাণ করতে হয়েছিল- তিনি মরেন নাই আমাদের ভাবখানাও ঠিক সেই রকম যে, আমরা মরে গিয়ে হলেও প্রমাণ করবো আমরা করোনাকে ভয় পাই নাই।
এই যে করোনা নামক ভাইরাস দেশের প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে তার পুরো কৃতিত্ব(!)কিন্তু আমাদের। করোনাভাইরাস একা একা কোথাও যেতে পারে না তার সংক্রমণের জন্য মাধ্যম প্রয়োজন হয়। আমরা বরং এই ভাইরাসকে দাওয়াত দিয়ে আমাদের জেলাগুলোতে নিয়েছি। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর যখন সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হলো তখন আমরা সদলবলে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছি, ছুটি পাবার আনন্দে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি, কারণে অকারণে বাসা থেকে বের হয়ে জমায়েত সৃষ্টি করেছি, আড্ডা জমিয়েছি। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে সৃষ্ট আপদকালীন ছুটিকে রীতিমত উৎসবের ছুটি বানিয়ে আমরা একপ্রকার নিমন্ত্রণ করে করোনাভাইরাসকে প্রতিটি জেলায় আসার পথ সুগম করেছি। এ যেন বহুদিনের কাঙ্খিত অতিথি বরণ করে নেয়া!
আমাদের স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করে করা গোঁয়ার্তুমির কারণে যখন করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে চলছিল তখন ও আমাদের হুঁশ ফেরেনি। বরং আমাদের গোঁয়ার্তুমির পরিমাণ এতই বেড়েছে যা অষ্টম সপ্তাহ থেকে দশম সপ্তাহের আক্রান্তকে করেছে তিনগুন। এমনকি সংযমের মাস রমজান মাসেও আমরা চরম অসংযমের পরিচয় দিয়েছি। যেহেতু রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা রোজা রাখে তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং দেশের ভ্রাম্যমাণ লোকদের ইফতারের কথা চিন্তা করে দেশের হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো ইফতার বিক্রির জন্য খোলা ছিল। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা বাহারি ইফতার করার জন্য দোকানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে লাইন দিয়েছি।এমন না যে সেই উপাদান গুলোর কোন ধর্মীয় গুরুত্ব আছে। বরং নবীজীর ইফতারের বর্ণনা পাওয়া যায় তিরমিযি ও আবু দাউদ শরীফে। হযরত আনাস বলেন, নবীজী (সা.) তাজা কয়েকটি খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙতেন। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনা খেজুর। শুকনা খেজুর না থাকলে কয়েক ঢোক পানি। এই ছিল রাসুল (সা.) এর ইফতারি। যে খাবার গুলোর ধর্মীয় কোনো গুরুত্ব নেই যেই খাবারগুলো কিনতে যাওয়া ছিল এবার সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। সেই খাবারগুলো কেনার জন্য আমরা শুধু নিজেকে না, বরং নিজের পরিবার এমনকি প্রতিবেশী অন্যান্য রোজাদারদের ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে দ্বিধা করিনি। এতো দিনে কারোই অজানা ছিল না যে কেউ করোনা আক্রান্ত হওয়া মানে তার পরিবার এমনকি প্রতিবেশী ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পরা। এসব জানা সত্বেও আমরা সংযমের মাসে চূড়ান্ত অসংযমের পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করিনি।
সর্বশেষ যে কাজটিকে কেন্দ্র করে আমাদের দিতে হচ্ছে চরম মুল্য তা হচ্ছে ঈদের কেনাকাটা। যে সময়ে দেশে শনাক্তকৃত সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক সেই সময় যেন কেনাকাটার ঢল নেমেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমরা যে কত অবিবেচক হতে পারি তা এই ঈদের কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি লালমনিরহাটে করোনা আক্রান্ত এক যুবকের ঈদের কেনাকাটা করার ঘটনা কিংবা নোয়াখালীতে করোনা আক্রান্ত দোকানদারের দোকান খুলে ব্যবসা করার ঘটনা। এই ধরনের ঘটনা জাতির জন্য কি ভয়াবহ দিন আনতে পারে ভাবলেই গা শিউড়ে উঠে! এমনকি জাতিকে এরূপ ভয়াবহ বিপদে ফেলে তথাকথিত কেনাকাটার কোন ধর্মীয় গুরুত্ব ও নেই বরং ইমাম তাহাভিসহ অন্য সব মুহাদ্দিসের মতে ইসলামের বিধান হচ্ছে নতুন পোষাক নয়, প্রত্যেকের কাছে যে কাপড়গুলো আছে এর ভেতর সুন্দরটা পরিধান করবে।
আচ্ছা, আমরা যারা দিনের পর দিন নিজেকে, পরিবারকে এবং সমাজকে ঝুঁকির মুখে ফেলে একের পর এক বদ্ধউন্মাদের মত আত্মঘাতী কাজ করে চলেছি তারা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমাদের এই কাজের কারণে জাতির কাছে আমরা এক আত্মঘাতী নরকীট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হব?
হয়ত একটি নতুন জামা ছাড়া এই বারের ঈদ আমরা পার করতে পারবো কিন্তু কোনো কারণে ঈদের কাপড় কিনতে গিয়ে যদি স্বজন হারাতে হয় তাহলে সেই স্বজন হারানোর বেদনায় আমরা আর জীবনের কোনো ঈদই ঠিক মতো পালন করতে পারবো না। তাই সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমাদের কাছে কোনটি বেশী মুল্যবান? নিজের এবং নিজের পরিবারের জীবন, নাকি নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কেনাকাটা নামক ধু ধু মরীচিকা?
Posted ২:১২ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২০ মে ২০২০
America News Agency (ANA) | Payel