পৃথিবীর নানা দেশ জ্ঞানের বিকাশ, গবেষণার আবশ্যকীয়তা, সভ্যতা-সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন আর ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদে এবং সময়ের চাহিদা পরিপূরণ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের মানসে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করেছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার সংগ্রামী ইতিহাস আর ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার দিয়ে কোনো জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছে- বিশ্ব-ইতিহাসে তা বিরল। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য মহিমা; যে তার ঐতিহাসিক সংগ্রামী বৈশিষ্ট্য দিয়ে বাঙালি জাতির ভাষার অধিকারসহ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ-এর গোড়াপত্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালির প্রাণের সেই বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে সমুপস্থিত। ১৯২১ থেকে ২০২১; এই শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়টি বাঙালি জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গবেষণা-উদ্ভাবন, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, প্রগতিশীল ভাবনা, জাতি গঠন ও দেশাত্মবোধক চেতনার এক তেজোদীপ্ত আলোকবর্তিকা; বাঙালির সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার শতবর্ষী অনন্য বাতিঘর।
২১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তির গৃহীত কর্মসূচির সূচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অর্গানাইজিং কমিটি’ আয়োজিত ‘সেলিব্রেটিং দ্য হান্ড্রেড ইয়ারস অ দ্য ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা: রিফ্লেকশনস ফ্রম দ্য এলামনাই-ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ন্যাশনাল’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে শতবর্ষ উপলক্ষে গৃহীত ছয়টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায়। মূলত এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা সূচিত হবে এবং আগামী ১ জুলাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আজকের উদ্বোধনী পর্বটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, এরই ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রতিষ্ঠিত অ্যালামনাইবৃন্দের সমন্বয়ে ছয়টি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হবে। এগুলো হলো- ১) হিস্ট্রি অব দি ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা অ্যান্ড হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২) সায়েন্সেস ফর সোসাইটি ৩) আর্টস, লিটারেচার অ্যান্ড কালচার ৪) বিজনেস ফর সাসটেইনেবিলিটি ৫) সোশ্যাল সায়েন্সেস ফর লাইফ অ্যান্ড লিভিং এবং ৬) ফিউর্চাস অব হায়ার এডুকেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক গবেষণা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ এবং এর আন্তর্জাতিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উপরিউক্ত ছয়টি আন্তর্জাতিক সেমিনার সেই কর্মপরিকল্পনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, গবেষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিশেষ করে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি ও সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে আগামী ১২-১৪ জুলাই ২০২১ লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠিতব্য এ সম্মেলনের জন্য নিল্ফেম্ন উল্লিখিত সাতটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে- ১) হিস্ট্রি অ্যান্ড হেরিটেজ :দি ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা অ্যান্ড দি অপব্রিজ মডেল অব ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ২) ক্লাইমেট চেঞ্জ, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হায়ার এডুকেশন ৩) জেনোসাইড, ডিসপ্লেসমেন্ট অব পপুলেশন্স অ্যান্ড হায়ার এডুকেশন ৪) দি বাংলাদেশি দায়াসপোরা অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ৫) দি বাংলাদেশ ইকোনমি ইন দি পোস্ট-পেন্ডামিক ওয়ার্ল্ড: দি রোল অব ইউনিভার্সিটিজ ৬) দি ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা অ্যান্ড ইট্স অ্যালামনাই এবং ৭) দি ইভলভিং জিওপলিটিপ অব আওর এজ অ্যান্ড বাংলাদেশ-ইউকে রিলেশন্স। উপরিউক্ত সাতটি বিষয়ে আলাদা সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনে গৃহীত কর্মসূচির আওতায় দৃষ্টিনন্দন মল চত্বরে ল্যান্ডস্কেপিংসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে একটি ‘সেন্টেনারি মনুমেন্ট’ নির্মাণ কাজ অচিরেই সম্পন্ন করা হবে। শতবর্ষপূর্তিকে আরও অর্থবহ করে তুলতে আয়োজন করা হবে নানা বিষয়ে গবেষণা মেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও প্রত্যাশা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার রচনা প্রতিযোগিতা ও শীর্ষ ১০০ জনকে পুরস্কৃত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাইদের স্বরচিত কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ, মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ, মৌলিক গ্রন্থাবলি রচনা ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকাগুলোর আধুনিকায়ন ও শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, অত্যাবশ্যকীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংযোজনসহ বিশ্বদ্যিালয়ের গবেষণাগারগুলোকে মানসম্মত করা, শতবর্ষের ওপর বিশেষ স্যুভেনির প্রকাশ, প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকশপে স্যুভেনির কর্নার স্থাপন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা, পৃথিবীর বিভিন্ন মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর ও এপচেঞ্জ প্রোগ্রাম বৃদ্ধিকরণ, শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন ও সেরাদের পুরস্কৃতকরণ এবং সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনও কার্যসূচিতে রয়েছে। এ ছাড়া বাঙালির ইতিহাস নির্মাণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং জাতি গঠনের পরতে পরতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনস্বীকার্য অবদানকে কেন্দ্র করে বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক গ্রন্থ রচনাসহ বছরব্যাপী পালনের জন্য বিস্তর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে শত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও বৈশ্বিক সব সূচকে প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটাতে প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত, সুদূরপ্রসারী ও সামগ্রিক মহা কর্মপরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে একটি সময়োপযোগী ‘মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন করেছেন, যা গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। এবার প্রয়োজন সরকারের আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করে প্রণীত এই মাস্টারপ্ল্যানের সফল ও কার্যকর বাস্তবায়ন। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ফ্লোর স্পেসের (১৭ লাখ বর্গফুট) ঘাটতি, আধুনিক গবেষণাগারের অভাব, লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা, জলাবদ্ধতার সমস্যা, যথাযথ ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেনের অভাব, যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, মানসম্পন্ন খেলার মাঠের স্বল্পতা (বিশেষ করে ছাত্রীদের কোনো নির্দিষ্ট খেলার মাঠ নেই), ছাত্রছাত্রীদের আবাসন সংকটসহ বিদ্যমান বহুমাত্রিক সমস্যার বাস্তব সমাধান মিলবে।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ- এতদঞ্চলে এই তিনকালের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিগত এক শতাব্দীকাল ধরে এ দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও গবেষণার বাতিঘর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ জাতি গঠন ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষ ও উপযুক্ত মানবসম্পদও সৃষ্টি করে চলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গেরও স্মৃতিধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুভাগমন উপলক্ষে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের নিমিত্তে রচিত ও অপঠিত মানপত্রে রয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি বা ইনস্টিটিউশন অবিনশ্বর নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। আমাদের মতে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা কিভাবে গড়ে উঠবে তা অতীতের মত ভবিষ্যতেও বহুলাংশে নির্ণীত হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আপনার, আপনার সরকারের ও বাংলাদেশের জনগণের সুদৃষ্টি ও সহানুভূতি আমরা আশা করি।’
দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতা বিচারেও উপরিউক্ত বক্তব্য সমভাবে প্রযোজ্য। এমনকি যতদিন বাংলাদেশ থাকবে; এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ও ঈর্ষণীয় ভূমিকাও ততদিন পর্যন্ত দেদীপ্যমান ও অক্ষয় থাকবে। এ দেশের মানুষের সব মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ এক যুগ আগে ওয়ান-ইলেভেনের ভয়াল দুঃসময়ে অন্ধকারের অগণতান্ত্রিক শক্তি যখন জগদ্দল পাথরের মতো গোটা জাতির ওপর চেপে বসেছিল; এ অবস্থার উত্তরণে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই গর্জে উঠেছিল। পালন করেছিল তার ঐতিহাসিক ভূমিকা। কারারুদ্ধ জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি, অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর দাবিতে অহিংস অথচ প্রবল গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল চত্বর থেকেই। ক্রমান্বয়ে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণবিস্ম্ফোরণের রূপ পরিগ্রহ করে। শিক্ষকদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন, শিক্ষক সমিতির তলবি সভা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত মিছিল ও স্লোগান, কারাগারে বন্দি দেশরত্ন শেখ হাসিনার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে স্বল্পসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের স্বাক্ষর সংবলিত এবং গণমাধ্যমে প্রেরিত ও প্রকাশিত প্রথম বিবৃতি, কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিক্ষোভ প্রকাশের প্রতীক হিসেবে কালো পতাকা উত্তোলন- এ সবই হয়েছিল বিপদাপন্ন দেশ, দুঃশাসনকবলিত জাতি, সংকটাপন্ন গণতন্ত্র ও বিপন্ন মানবতাকে সুরক্ষার মহান তাগিদে এবং সর্বোপরি গণমানুষের বৃহত্তর স্বার্থে। সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে দুঃসাহসী আন্দোলনে জীবন-মাল বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু অসম সাহসী মানুষ।
তাই এ দেশ ও জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। শতবর্ষ উদযাপনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে সরকার ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা জাতির এ গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়কে সে আলোকেই মূল্যায়ন করবেন- এ আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ১০:২২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২২ জানুয়ারি ২০২১
America News Agency (ANA) | Payel