শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

আবেগে কান্দন আসার বাজেট!

গোলাম মাওলা রনি :   শনিবার, ১০ জুন ২০১৭ 706
আবেগে কান্দন আসার বাজেট!

যার কথা বলছি তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং আকর্ষণীয় তরুণী সাংবাদিক। কাজ করেন দেশের নামকরা একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। জাতীয় সংসদে পেশ হওয়া সাম্প্রতিক বাজেট নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি সোস্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেন, ‘বাজেটের রকমসকম দেখে তার আবেগে কান্দন চলে এসেছিল। অর্থমন্ত্রী মাহোদয়ের একটি মন্তব্য শোনার পরপরই তিনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। মন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে যাদের এক লক্ষ টাকার ব্যাংক ব্যালান্স রয়েছে তারা যথেষ্ট সম্পদশালী। সুতরাং অর্থমন্ত্রীর পেশকৃত বাজেটে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপর আরোপিত শুল্ককর পরিশোধে সেইসব যথেষ্ট সম্পদশালীদের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’ তরুণী সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে নিজের জীবনের নতুন ঠিকনা খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বেশ সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং অতীব আহ্লাদের সাথে জানিয়েছেন, ব্যাংকে তার এক লাখ টাকা রয়েছে যা নিয়ে তিনি এখন বেশ গর্ব অনুভব করছেন।
তরুণী সাংবাদিকের ভাষ্য মতে, তিনি বহু দিন ধরে এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগছিলেন। তিনি কি বর্তমান বাংলাদেশের ডিজিটাল উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে একজন নিম্নবিত্ত মানুষ নাকি মধ্যবিত্ত মানুষ। প্রায়ই তিনি মেঘ, বৃষ্টি, ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে নিয়মিতভাবে সঠিক সময়ে অফিসে হাজিরা দিতে গিয়ে নিজের ক্ষুধা-যন্ত্রণার প্রয়োজনের তাগিদ এবং ডেডিকেশনের তাড়নার মধ্যে সমন্বয় করতে পারেন না। তার নিন্দুকেরা তাকে ক্ষুধা ও দ্রারিদ্র্যের যন্ত্রণায় ছুটে চলা একজন নিম্ন আয়ের পেশাজীবী বলে যে ঠাট্টা-মশকরা করত, তা থেকে তিনি রেহাই পেয়েছেন অর্থমন্ত্রীর কল্যাণে। তিনি এখন নিজেকে যথেষ্ট বিত্তশালীদের কাতারে শামিল দেখতে পেরে আবেগে কান্দন আরম্ভ করে দিয়েছেন।
শিক্ষিতা তরুণী সাংবাদিকের অভিব্যক্তিটি আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু লিখতে গিয়ে তার ব্যবহৃত কান্দন শব্দটি নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কারণ আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ ইদানীংকালে প্রমিত বাংলা, আবেগ বিবর্জিত মানবতা এবং ধর্ম বিবর্জিত সভ্যতা নিয়ে বেশ সচেতন। তারা হয়তো কান্দনের পরিবর্তে কান্না শব্দটির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হবেন। তারা জানলেও হয়তো বলবেন না যে, কান্না একটি সাধারণ ক্রিয়াবাচক শব্দ। রাগ, ক্রোধ, মেকি, অভিনয় ইত্যাদি সবক্ষেত্রে সচরাচর কান্নার মাধ্যমে যে মানব মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তার সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু আবহমান বাংলার কান্দন শব্দের সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। কারণ মানুষ যখন আবেগতাড়িত বা বেদনাহত হয়ে হৃদয়ের অশ্রুগুলো চোখ দিয়ে বের করতে পারে তখন কান্নার পরিবর্তে কান্দনই স্বার্থক ক্রিয়াপদ হিসেবে মানানসই হয়।
সাম্প্রতিক বাজেট নিয়ে একটি সরকারি কলেজের ইংরেজি অধ্যাপিকার মন্তব্যও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি বলেন- অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠে বিত্তশালীদের সংজ্ঞা শোনার পর গর্বে তার মাটিতে পা পড়ছে না এবং আনন্দে ঘুমও আসছে না। কারণ একটি মাত্র ঘোষণায় তিনি বিত্তশালীতে পরিণত হয়েছেন। সুতরাং তার ছেলেমেয়েরা এখন বিত্তশালী পরিবারের সন্তান বলে স্বীকৃতি পাবে। কাজেই কোনো সাধারণ পরিবার থেকে যদি তাদের বিয়ের প্রস্তাব আসে তবে তিনি তা কিছুতেই বরদাশত করবেন না।
উপরিউক্ত ঘটনাগুলোর মতো শত সহস্র কৌতূহলোদ্দীপক এবং রসালো সব প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে বর্তমান বাজেট নিয়ে। ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব এবং জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রে শতকরা পনের ভাগ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব সর্বস্তরে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন টকশো, হাটবাজার, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, উপাসনালয় ইত্যাদি জায়গাগুলোতে বাজেটের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে মারাত্মক সব সমালোচনা শুরু হয়েছে এবং সবাই যে যার সাধ্যমতো অর্থমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকার নিয়ে যাচ্ছেতাই খিস্তিখেউড় করে যাচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ গত মাসখানেক আগে নিজ দলের এমপি-মন্ত্রীদের দলীয় কার্যালয়ে জড়ো করে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কিভাবে দলীয় প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতে হবে এবং কিভাবে সমালোচক, প্রতিপক্ষ, শত্রু এবং শ্রেণীশত্রুদের প্রচার প্রপাগান্ডার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে যে বিষয়ে দলীয় আইটি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণটি পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু দল ও সরকারের বিপদের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মন্ত্রী-এমপিরা কিছুই করতে পারেননি। দু-একজন একটু চেষ্টাতদবির করেছিলেন বটে কিন্তু প্রবল গণরোষের তীব্র ঝাঁঝালো সব মন্তব্য শুনে তারা ক্ষান্ত দিতে বাধ্য হন।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ভ্যাট নিয়ে শেষাবধি কী হবে বলা যাচ্ছে না। তবে ব্যাংক হিসাবের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত আবগারি শুল্ক যে প্রত্যাহার করা হবে তা মুটোমুটি নিশ্চিত। অবাক করা বিষয় হলো সরকারসমর্থক বিরোধী দল, সরকারি জোটের শরিকেরা এবং হাল আমলের সরকারি বন্ধু হেফাজতে ইসলাম আবগারি শুল্ক বাতিলে জোর দাবি তুলেছে। আরো আরো অবাক করা বিষয় হলো- আওয়ামী লীগ স্বয়ং দলীয়ভাবে আবগারি শুল্কের প্রত্যাহার দাবি করেছে। এত্তোসব ঘটনা পরিক্রমার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সাংবাদিকদের একটি ইফতার মাহফিলে নানারকম তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ও কথাবার্তার সঙ্গে আবগারি শুল্কায়নের অতিরিক্ত হার প্রত্যাহার করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও সমালোচনা বন্ধ হচ্ছে না। লোকজন বেশ আটঘাট বেঁধে এমন সব মর্মান্তিক সমালোচনা শুরু করেছে, যা আখেরে সরকারের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না।
চলতি বাজেট নিয়ে সরকারের অবস্থা হয়েছে পচা শামুকে পা কাটা এবং কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে যাওয়ার কাহিনীর মতো। কারণ ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্কারোপ সেই ১৯৪৬ সাল থেকেই ছিল। এবার শুধু শুল্কের পরিমাণটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এমনভাবে প্রচারিত হয়েছে যাতে মনে হয়েছে অর্থমন্ত্রী এবারই প্রথম এ ধরনের শুল্ক আরোপ করলেন। দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিক তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট এক মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে আবগারি শুল্ককে পাপকর বলে অভিহিত করেছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পরের দিন থেকেই জনমত সরকারের এতটাই বিরুদ্ধে চলে যায়, যা নীতিনির্ধারকদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে। তারা ভেবে পাচ্ছেন না- কেন অর্থমন্ত্রী সামান্য কিছু অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্য আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন আর এ ঘোষণায় কেন ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই একত্র হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বাজেটে বিভিন্ন প্রকার কর ও ভ্যাটের জাল এমনভাবে বিস্তার করা হয়েছে যার কারণে ধনী-দরিদ্র থেকে শুরু করে রাস্তার ভিখেরিরা পর্যন্ত করের আওতায় চলে আসবেন। ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধির কারণে ভোগ্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে শুরু করে শিশুখাদ্যের মূল্য গড়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি প্রভৃতি সরকারি সেবার ওপর নতুন নিয়মে ভ্যাট আরোপের ফলে এক দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো বাজেট নিয়ে চলতি বাজেটের মতো এমন জটিল, কূটিল এবং বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী বলছেন, এটা নাকি তার জীবনের সবচেয়ে সেরা বাজেট।
কোনো একটি দেশে বা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপদের ঘনঘটার অশনিসঙ্কেত তখনই প্রবল হয়ে যায়, যখন নেতা এবং অনুসারী কিংবা, জনগণ নেতা অথবা সুবিধাভোগী এবং সুবিধা প্রদানকারীরা পরস্পরের মনোভাব বুঝতে পারে না। শুধু অর্থনৈতিক দুরবস্থা অথবা অব্যবস্থাপনার কারণে ইতিহাসের মহাকালে কত বড় বড় সরকার, সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের যে পতন হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল চায়ের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে, বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়েছিল কিন্তু বাজেটসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। সরকারের যেসব কর্তাব্যক্তি ইতিহাসের নির্মম ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবহিত তারা নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীর মতো চলতি বাজেটকে একটি সেরা বাজেট বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন না।
চলতি বাজেট নিয়ে যে জটিলতা শুরু হয়েছে তা খুব সহজে মিটমাট হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। দেশের বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ এবং ভিন্নমতের প্রথিতযশা রাজনীতিবীদেরা বাজেটটিকে একটি অনৈতিক বাজেট বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ এটাকে গণবিরোধী এবং ভাঁওতাবাজির বাজেট বলেছেন। যারা অনৈতিক বাজেট বলেছেন তাদের যুক্তি হলো গত সাত বছরে দেশ থেকে যে আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেল, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শেয়ারমার্কেট থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লোপাট হলো, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো লুটেরাদের কবলে পড়ে মূলধন হারিয়ে দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে পৌঁছালো ইত্যাদি কলঙ্কময় অধ্যায় নিয়ে বাজেটে একটি শব্দও লিখিত হয়নি। বরং জনগণের করের টাকা ভর্তুকি হিসেবে দিয়ে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার মাধ্যমে সরকার মূলত লুটেরাদের পিঠ রক্ষার জন্য ভয়ানক এক অনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করল।
বাজেটকে যারা গণবিরোধী ও ভাঁওতাবাজি বলে আখ্যায়িত করেছেন তাদের যুক্তিও ফেলে দেয়ার মতো নয়। চলতি বাজেটে ঘাটতি থাকবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। অন্য দিকে, বিগত বাজেটে এডিপি বাস্তবায়নের যে হার তাতে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় তাদের অনুকূলে বরাদ্দ করা অর্থের অর্ধেকও খরচ করতে পারেনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বাজেটের এডিপি যদি অর্ধেক বাস্তবায়িত হয় তবে মোট বাজেটের পরিমাণ হবে মাত্র দুই লাখ কোটি টাকার মতো। অথচ সরকার চার লাখ কোটি টাকার চেয়েও বড় আকৃতির একটি বাজেট পেশ করে নিজেদের বড়ত্ব জাহির করার জন্য যে ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছে, যার পরিণতি কোনো পক্ষের জন্যই ভালো হবে না।
চলতি বাজেটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার প্রত্যাহার করা হলেও পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। কারণ বেশির ভাগ মানুষ জানতেন না, তাদের সঞ্চয়ী হিসাব বা স্থায়ী আমানতের লভ্যাংশের ওপর আবগারি শুল্ক, আয়কর এবং ভ্যাট আদায় করা হয়। চলতি বাজেট নিয়ে প্রচার প্রপাগান্ডার কারণে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের আস্থায় ফাটল ধরেছে। ফলে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা নিতান্ত বিপদে না পড়লে ব্যাংকের দিকে পা বাড়াবেন না। অনেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যেমন বন্ধ করে দেবেন তেমনি ব্যাংক লেনদেন থেকেও বিরত থাকবেন কেউ কেউ। পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রায় সাড়ে আট কোটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখান থেকে কেবল আবগারি শুল্ক বাবদ সরকার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় করে থাকে। অন্যদিকে, আমানতের ওপর অগ্রিম আয়কর এবং ভ্যাট থেকে আয়ের পরিমাণ ও প্রায় সম-অঙ্কের। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে এই খাত থেকে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় তো দূরের কথা, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বর্তমানের আরোপিত শুল্ক করেও ছাড় দেয়া লাগতে পারে।
চলতি বাজেটে প্রস্তাবিত নতুন ভ্যাট হার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ, বাজারজাত এবং খুচরা বিক্রয়ের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস শুরু হয়ে যাবে। তাদের দৈনন্দিন খাদ্যচাহিদা এবং অন্যান্য খরচ কাটছাঁট করে সরকারি তহবিল স্ফীত এবং সরকারি মদদে আশকারা পাওয়া নব্য ধনী, লুটেরা অর্থপাচারকারী এবং দুর্নীতিবাজদের লোভ-লালসা ও লিপ্সা পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হতে হবে। জাতীয় পুষ্টি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং চিকিৎসাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল সেবা, বৈদেশিক রেমিট্যান্সেও ভ্যাটের প্রভাব পড়বে। ফলে আগামী আর্থিক বছরটি সরকারের জন্য কি ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না!
বর্তমান বাজেট প্রণয়ন এবং পেশের মাধ্যমে সরকারের দুটো মনোভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী বাজেটপূর্ব আলোচনায় মন্তব্য করেছিলেন, এবারের বাজেটটি হবে মূলত রাজনৈতিক বাজেট। আগামী নির্বাচন মাথায় রেখে ভোটারদের তুষ্ট রাখার জন্য বাজেটে চমক লাগানো জনকল্যাণমূলক প্রকল্পসমূহ যেমন অন্তর্ভুক্ত করা হবে তেমনি কিছু জনপ্রিয় খাতে কর ছাড় দিয়ে জনগণের বাহবা নেয়ার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু বাজেট পেশের পর দেখা গেল সরকার প্রচলিত জল্পনা কল্পনার ঠিক বিপরীত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে প্রমাণ হয়েছে, আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে জনগণকে খুশি করার বিষয়টি সরকার এই মুহূর্তে ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছে না বা নেয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।
দ্বিতীয়ত, সরকার আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার বা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিয়তা লাভ করেছে বা বোধ করছে। ফলে জনগণের দুঃখ কষ্ট, আসা-আকাক্সক্ষা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদির পরোয়া না করে তারা তাদের ক্ষমতার ভিত্তি এবং সোপানগুলোকে আরো মজবুত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি করে আমলাতন্ত্রকে খুশি রাখা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে ঠিকাদার, ধনীক শ্রেণী, দলীয় নেতাকর্মী, ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা এবং বিদেশী চক্রের যে সিন্ডিকেটটি বর্তমানে চালু রয়েছে সেটিকে আরো শক্তিশালী এবং বেগবান করার জন্য বাজেটের মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার মূলত ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বিষয়ে অধিকতর নিশ্চয়তা পেতে চাচ্ছে।
দেশের একশ্রেণীর আশাবাদী মানুষ আগামীর সংসদ নির্বাচন অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছিল তাদের সেই আশায় গুড়েবালি পড়ে গেল চলতি বাজেট পেশের মাধ্যমে। সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া এবং বিনাভোটের নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন এবং পরিচালনায় যে সফলতা পেয়েছে এবং বলতে গেলে ভয়ানক মজা পেয়ে গেছে তা থেকে কোন দুঃখে এবং কী কারণে তারা বের হয়ে এসে ভুখা-নাঙ্গা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে-পায়ে ধরে ভোট প্রার্থনা করতে যাবে এবং নাক উঁচু অলস সরকারবিরোধী শহরে মধ্যবিত্ত, উঁচু মধ্যবিত্ত এবং ধনিক শ্রেণীর তোয়াজ তদবির করতে যাবে তা নিবন্ধকারের মাথায় ঢুকছে না।
চলতি বাজেট নিয়ে উপরিউক্ত সমালোচনার পাশাপাশি বেশ কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। প্রযুক্তি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাজেটপূর্ব সময়ে অর্থমন্ত্রী কৃষকের কথা জানার জন্য এবং তাদের মনোবেদনা অনুভব করার জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠি জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় গিয়ে সন্ধ্যার পর যেভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে শত শত কৃষকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তা বাংলাদেশে এর আগে কোনো দিন ঘটেনি। চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কৃষকের বাজেট ভাবনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে একজন প্রবীণ মানুষ যে কষ্ট সহ্য করে এবং ধৈর্য ধরে কৃষকদের দাবিদাওয়া শুনেছেন এবং সেগুলো পূরণের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রেখেছেন এবং বাজেট বক্তৃতায় কৃষকদের নিয়ে কথা বলেছেন তা আমার মতো অনেককেই আবেগতাড়িত করেছে।

Facebook Comments Box

Comments

comments

Posted ১:৩৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১০ জুন ২০১৭

America News Agency (ANA) |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

 

President/Editor-in-chief :

Sayeed-Ur-Rabb

 

Corporate Headquarter :

 44-70 21st.# 3O1, LIC. New York-11101. USA, Phone : +6463215067.

Dhaka Office :

70/B, Green Road, 1st Floor, Panthapath, Dhaka-1205, Phone : + 88-02-9665090.

E-mail : americanewsagency@gmail.com

Copyright © 2019-2024Inc. America News Agency (ANA), All rights reserved.ESTD-1997