যুক্তরাষ্ট্রে একজন মানুষের বাড়ি থাকা খুব কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। কারও যদি দুই বছরের ট্যাক্সের ভালো ইনকাম থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি তার আয়ের প্রমাণপত্র দেখিয়ে লোন নিয়ে বাড়ি কিনতে পারেন। কোনো ব্যক্তির আয় ও অন্যান্য কী কী লোন আছে, কিস্তি কত পরিশোধ করতে হয়, ব্যয় কত, এর ওপর নির্ভর করে তিনি কী পরিমাণ অর্থ লোন পাওয়ার যোগ্য। এই লোন নিলে কত ইন্টারেস্ট রেট হবে। ৩০ বছরের ফিক্সড লোনের ক্ষেত্রে তার মাসে কত ডলারের কিস্তি আছে। ব্যাংকের মূল অর্থ পরিশোধের পাশাপাশি লোনের অর্থের ওপর ইন্টারেস্ট হবে। সেই ইন্টারেস্ট যোগ করেই মাসিক মর্টগেজের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এর সঙ্গে রয়েছে বাড়ি ট্যাক্স, ইন্স্যুরেন্স, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পিএমআই। এর বাইরেও রয়েছে বাড়ির ইউটিলিটি বিল। কে কত পরিমাণ খরচ করছেন, এর ওপর ইউটিলিটি বিল আসবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, হিট, গার্বেজ, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন ধরনের বিল রয়েছে। সেখানেও গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। কারও ইনকাম এক লাখ ডলার হলে তিনি হয়তো পাঁচ লাখ ডলারের মতো বাড়ি কেনার জন্য লোন পাবেন। ওই অর্থ দিয়ে তিনি পছন্দমতো বড় বাড়ি কিনতে পারবেন কি না, সেটিও দেখার বিষয়। কারণ কোনো ব্যক্তি যে পরিমাণ অর্থ প্রি অ্যাপ্রুভাল পান, সে অনুযায়ীই বাড়ি খুঁজতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা চাকরি করেন তাদের বার্ষিক ইনকাম ফিক্সড। যারা ব্যবসা করেন, তাদের আয় নির্ভর করে ব্যবসার লাভ-লোকসানের ওপর। সেটা যা-ই হোক, বাড়ি কেনার জন্য যে বছর বাড়ি কিনছেন, সেই সময়ের গত দুই মাসের পে স্টাব, ডাউন পেমেন্টের জন্য ব্যাংকে থাকা অর্থ এবং বার্ষিক আয় তার নিজের এবং যদি পরিবারের কারও আয় দেখাতে চান, সেই আয় যোগ করে যে ইনকাম হয়, সেই ইনকাম ধরেই আয় বিবেচনা করা হয়। একক নামে লোন হলে একক ইনকামই হবে। দুজন হলে যাদের নামে লোন হবে, তাদের আয় দেখানো হয়। সব আয় মিলিয়ে যে ইনকাম হয়, সে অনুযায়ী তার বর্তমান ব্যয় বাদ দিয়েই লোনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ২৫ শতাংশ কিংবা তারপরও বেশি ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাড়ি কিনতে পারেন। ডাউন পেমেন্ট, ক্লোজিং কস্টসহ অন্যান্য কস্ট বাদ দেওয়ার পর হাতে বা ব্যাংকে যে অর্থ থাকে, তা অন্তত বাড়ি কেনার পরবর্তী তিন মাস মর্টগেজ দেওয়া ও বাড়ির কিছু সংস্কার করা কিংবা ডেকোরেশনের জন্য ব্যয় হয়।
আমেরিকায় যাদের পেইড অফ বাড়ি রয়েছে, ওই সব সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ আলাদা। কারণ পেইড অফ বাড়ির মালিক যিনি বাড়ি কিনেছেন, তিনি মালিক হন। যে বাড়ি পেইড অফ হয়নি, ওই বাড়ির লোন যত দিন শোধ না হবে, তত দিন ব্যাংক কিংবা লোনদাতা সম্পত্তির মালিকানায় থাকবেন। অনেকের একাধিক বাড়ি আছে। তারা বাড়ির পেইড অফ করে ফেলেছেন। তারা আসলেই বাড়ির মালিক। কিন্তু যারা এক বা একাধিক বাড়ি কিনেছেন এবং ব্যাংকে তাদের লোন রয়েছে, লোন পরিশোধ করতে পারেননি, তারা বাড়ির মালিকানা সম্পূর্ণ পাবেন যখন তার পুরোপুরি লোন পরিশোধ হবে। তাই কেউ বাড়ি কিনলেই যে বাড়ির মালিক হয়ে গেছেন, এটা মনে করার কারণ নেই। মর্টগেজ দিতে না পারলে একসময় অনেক বাড়ি শর্ট সেলে বিক্রি হয়। আর ফোর ক্লোজারও হয়। যখন ফ্লোর ক্লোজারে বাড়ি বিক্রি হয়, তখন ওই বাড়িটি ব্যাংক কিংবা লোনদাতা প্রতিষ্ঠান নিয়ে নেয়। তারা ব্যাংকের অর্থ ওঠানোর জন্য বাড়ি বিক্রি করে। এটাই আমেরিকায় নিয়ম।
এসব জানার পরও সম্প্রতি অনেকের মধ্যেই বাড়ির মালিক বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কথায় কথায় কে কটি বাড়ির মালিক, সেটাও বলেন। আবার কেউ কেউ ফেসবুকেও বাড়ির ছবি দিয়ে সবাইকে জানান দেন নতুন বাড়ি কেনার খবরের কথা। সম্প্রতি নতুন একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছে, কিছু কিছু অভিভাবক তার ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজার সময় ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তার বাড়ি আছে, এটাও যোগ্যতা হিসেবে মূল্যায়ন করছেন। এ জন্য বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে দিচ্ছেন ছেলের বাড়ি আছে। যারা ঘটকদের মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা করতে চান, তারাও ছেলের যোগ্যতা হিসেবে শিক্ষা ও চাকরির পাশাপাশি বাড়ির কথা বলছেন। অনেক পাত্রীর অভিভাবকের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাত্রের অন্যতম যোগ্যতা বাড়ি থাকা। সব অভিভাবক অবশ্য ছেলের বাড়ি খোঁজেন এমন নয়। অনেকেই আছেন যারা ভালো, উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, সৎ, ভদ্র, সম্মানজনক চাকরি করে এমন ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান।
সূত্র জানায়, নতুন যে ব্যাচেলর পাস করে চাকরিতে জয়েন করেছেন, তার দুই বছর পর বাড়ি কিনছেন। তার বাড়ি পেইড অফ করা সম্ভব নয়। এটা করতে তার সময় লাগবে। কিন্তু তার পরও বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েপক্ষকে বাড়ি আছে কথাটা বলে এটাই বোঝানোর চেষ্টা যে ছেলের বাড়ি আছে। এটা জানলে পাত্রীপক্ষ নিশ্চিত হতে পারবে যে তার মেয়ের বিয়ে হলে মেয়েকে ভাড়া বাসায় উঠতে হবে না। ছেলের বাড়িতেই উঠতে পারবে।
ইদানীং পাত্রপক্ষের বাড়ি আছে বলে পাত্রের পরিচয় দেওয়া সম্পর্কে এক অভিভাবকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলের বাড়ি আছে কি না, এটা অনেক মেয়ের মা-বাবাই দেখতে চান। অনেক সময় পাত্রীও জানতে চান। তবে সেটি সংখ্যায় কম। বাড়ি না থাকলে বিয়ে দিতে চায় না। তারা মনে করে, ছেলের বাড়ি থাকলে বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে মেয়ে তার বাসায় উঠতে পারবে। মেয়েকে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি কেনার জন্য তার অর্থ শেয়ার করতে হবে না। আবার শ্বশুর-শাশুড়িও বিয়ের পর তাদের সঙ্গে থাকবে না। ফলে ঝমেলাও কমে যাবে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-বিবাদও কম হবে। বাবা-মাকেও বিয়ের পর মেয়ের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে দিলাম, ছেলের বাড়ি আছে। যেসব অভিভাবক বাড়িওয়ালা ছেলে খোঁজেন, তারা সহজেই পেয়ে যাবেন।
ছেলের সম্পত্তি দেখে কি মেয়ে বিয়ে দেবে? সুখ কি বাড়িতে লেখা-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই অভিভাবক বলেন, আসলে এটা বড় বিষয় নয়। অনেকেই জানতে চান ছেলের বাড়ি আছে কি না, তাই লিখে দিলাম ছেলের বাড়ি আছে। বাড়িটি ছেলের একা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ি ছেলের একার নয়। আমার ও আমার স্ত্রীর অংশ আছে। ছেলের মালিকানা ২৫ শতাংশ। একজনের এক বাড়িতে ২৫ শতাংশ মালিকানা থাকলে তিনি কি বাড়ির মালিক হতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাব নেই। তবে তার পরও তার দাবি, এটুকুতেই সে বাড়ির মালিক। আমরা আর কদিন। আমরা মারা গেলে সেই তো পুরো বাড়ির মালিক হবে।
আরেক অভিভাবক তার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন এমন একটি মেয়ে চান, যাকে তিনি মা বলে ডাকতে পারবেন। আবার তিনিও এমন সব পাত্রীর শর্র্ত জুড়ে দিচ্ছেন, মনে হচ্ছে তার জন্য আলাদা কোনো পাত্রী তৈরি করা আছে।
একজন অভিভাবক বলেন, ছেলে বিয়ে দেব বলে পাত্রী খুঁজছি। আমরা ছেলের সঙ্গেই থাকি। অনেক অভিভাবক বিয়ের জন্য পাত্রের যোগ্যতা দেখে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগ করার সব জানার পর জিজ্ঞেস করেন, ছেলের কি বাড়ি আছে। যখন বলি বাড়ি নেই, তখন সম্বন্ধ করতে আগ্রহী হয় না। মনে হয়, ছেলের বাড়ি না থাকাটা যেন অপরাধ। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ছেলের বাড়ি আছে কি না, এটা যদি যোগ্যতা হয়, তাহলে এত কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করালাম কেন?
আরেকজন অভিভাবক বলেন, আমরা দুজন ছেলের সঙ্গেই থাকি। ছেলে বিয়ে দেব বলে সুন্দরী পাত্রী খুঁজছি। ছেলের ইচ্ছা শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হলেও অপরূপ সুন্দরী মেয়ে লাগবে। সেভাবেই খুঁজছি। আমরা ভাড়া বাসায় থাকি। এটা অনেক মেয়ের বাবা-মায়ের পছন্দ নয়। আমরা ছেলের সঙ্গে থাকি, এটাও পছন্দ নয়। ছেলের বিয়ের পর তার সঙ্গে থাকব, সেটাও মেনে নিতে পারবে না। মেয়ের বাবা-মা চান ছেলের বাড়ি থাকতে হবে। মেয়ের বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের বড় যোগ্যতা বাড়ি।
একজন পাত্র বলেন, এখানে বিয়ে করাটা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা তিনজন মানুষ। এক বেডরুমের বাসায় বাবা-মাকে নিয়ে থাকি। বিয়ের জন্য অভিভাবকেরা পাত্রী খুঁজছেন। বিয়ের জন্য পাত্রীপক্ষ জানতে চান ছেলের বাড়ি আছে কি না। বাড়ি না থাকলে বিয়ে হবে না। বর্তমানে বিয়ের বাজারে পাত্রীপক্ষের কাছে ছেলের বাড়ি থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে।
Posted ৬:২১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৬ আগস্ট ২০২৩
America News Agency (ANA) | ANA