নিউইয়র্ক সিটিকে বলা হয় বিশ্বের রাজধানী। শুধু বাণিজ্যিক কারণে নয়, অভিবাসী নগরী হিসাবেও বিশ্বের কাছে সুপরিচিত নিউইয়র্ক। আয়তন ও জনসংখ্যার আধিক্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এই নিউইয়র্ক সিটি। একসময় শান্তির শহর ছিল। এরপর সময়ের বিবর্তনে অপরাধের স্বর্গরাজ্যও হয়েছে। সুশাসনে আবার শান্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিউইয়র্ক সিটি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সব মহলে। সর্বত্র বেড়েছে অপরাধ। রাত হলেই খইয়ের মত ফুটছে গুলি। আর এই অপরাধ দমনে ব্যর্থ প্রশাসন।
সাম্প্রতিক অপরাধ বিবেচনায় খোদ নিউইয়র্ক পুলিশের সাবেক কমিশনার হাওয়ার্ড সাফির বলেছেন, আমরা খারাপ পুরনো দিনে ফিরে যাচ্ছি।’ অর্থাৎ অপরাধের নগরীর পুরনো চেহারায় ফিরছে নিউইয়র্ক সিটি।
একসময় নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কস অপরাধপ্রবণ এলাকা ছিল। ছিনতাই-রাহাজানি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সে ক্ষেত্রে কিছুটা শান্তি ছিল কুইন্সে। কিন্তু সেই কুইন্সে এখন অপরাধ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী। পাঁচ বরোর মধ্যে তিনটি বরোই এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। রাত হলেই শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত নগরী নিউইয়র্ক এখন নতুন সংকটের মুখোমুখি। অনেকটাই ভেঙে পড়েছে নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। নগরীতে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে অপরাধ। অস্ত্রসহিংসতা অতীতের রেকর্ড ছড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা, কুইন্স দিন দিন দখলে যাচ্ছে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীদের। ফলে শান্তিতে বসবাস করার সময় ফুরিয়ে আসছে।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩১ জুলাই শনিবার পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটিতে ৮৯৮টি গোলাগুলির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের মধ্যে ৭৭১ টির তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের অদূরে ৩৭ অ্যাভিনিউ ও ৯৫ অ্যাভিনিউতে শনিবার রাতে প্রকাশ্যে গোলাগুলি হয়েছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১০জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, এই গোলাগুলির ঘটনায় গ্যাং সদস্যরা জড়িত। তাদের কাজই হচ্ছে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা। এরপর অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা। একসময় নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড গ্যাং সদস্যদের অভয়ারণ্য ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনো এই গ্যাংদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। কিন্তু এই গ্যাংরাই এখন কুইন্সের দখল নিচ্ছে। প্রায় প্রতি রাতে কুইন্সের বিভিন্ন এলাকায় তারা সন্ত্রাস করছে। নিরাপরাধ পথচারীদের গুলি করছে।
নিউইয়র্ক পুলিশের সাবেক কমিশনার হাওয়ার্ড সাফির উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আমেরিকানরা সম্মানজনকভাবে শান্তিতে জীবনযাপন করতে চায় এবং আমরা এই মূল জনগোষ্ঠীর কথাই এখন শুনছি। সম্প্রতি বন্দুক সহিংসতার প্রতিক্রিয়া জানাতে ‘ফক্সনিউজ লাইভ’ এ যোগ দিয়ে একথা বলেন তিনি।
হাওয়ার্ড সাফির বলেন, হচ্ছেটা কি? সত্যি বলতে আমরা খারাপ পুরানো দিনে ফিরে যাচ্ছি। আমরা পুলিশকে অপমান করেছি, আমরা পুলিশের তহবিল কমিয়ে দিচ্ছি এবং আমরা পাগলাটে জামিন আইন নিয়ে এসেছি। এই জামিন আইন পরিচিত অপরাধীদের মুক্তি দেয়। যারা একই অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং একই অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে, আমরা ওই অপরাধীদের কাছে একটি বার্তা পাঠাচ্ছি যে পুলিশকে আপনার ভয় করতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, আপনি জানেন যে আমি যখন কমিশনার এবং কমিশনার কেলি ও কমিশনার ব্র্যাটন ছিলাম, তখন কেবলমাত্র পুলিশকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন ছিল অপরাধীদের। সুতরাং ওইসময় ভয়ে তারা তাদের অস্ত্র বাড়িতে রাখতো। তারা যা করতো সে সম্পর্কে তারা খুব সতর্ক থাকতো এবং তারা অপরাধ করে ফেললে নিউইয়র্ক সিটির বাইরে চলে যেতো। আসল কথা হলো অপরাধীরা যদি পুলিশকে ভয় না করে, যদি জবাবদিহিতা না থাকে এবং গ্রেফতারের নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে তারা যা সবসময় করে তাই করবে, অপরাধ করবে।
সাবেক কমিশনার হাওয়ার্ড সাফির আরও বলেন, সিয়াটল, নিউইয়র্ক ও পোর্টল্যান্ডের মতো শহরের বামপন্থী রাজনীতিবিদরা তাদের শহর ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এবং অ্যান্টিফার কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত উপায় হলেও আমি আনন্দিত হয়েছি যে সিয়াটলের মেয়র যিনি পুরো শহরকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের হাতে তুলে দিয়েছেন এখন তিনিই বেশি করে পুলিশ ডাকছেন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন। এর কারণ শান্তির জন্য মার্কিনীদের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর। আমেরিকানদের অধিকাংশই সম্মানজনকভাবে শান্তিতে জীবন যাপন করতে চান এবং আমরা এই মূল জনগোষ্ঠীর কথাই শুনছি।
এদিকে ‘ডিফান্ড পুলিশ’ নামের আন্দোলন জোরালো হওয়ার পর নগরীর অপরাধপ্রবণতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। এনওয়াইপিডির কমিশনার ডারমট শিয়া এর আগে জানিয়েছেন, নগরীতে খুন পাঁচ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আগের বছরের চেয়ে এ পর্যন্ত ৪২ শতাংশের বেশি লোক এ নগরীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
এনওয়াইপিডির পুলিশ ইউনিয়ন বলেছে, রাজনীতিকেরা অপরাধীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছেন। নগরীর মেয়র ও সিটি কাউন্সিল স্পিকার কোরি জনসন এসব ঘটনার জন্য দায়ী বলে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
নিউইয়র্কে করোনাপরবর্তী সময়ে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বেড়েছে। ২৫ মে মিনেসোটার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিনিয়াপলিসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর নাগরিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা আমেরিকায়। নিউইয়র্কে এ আন্দোলনের সুযোগে ব্যাপক লুটতরাজ হয়েছে। বিপুলসংখ্যক পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নিউইয়র্ক রাজ্য ও নগরী দ্রুত পুলিশ সংস্কারের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ নিয়ে পুলিশের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ব্রুকলিনের কমিউনিটি সংগঠক টনি হার্বার্ট সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর আগে গত পাঁচ বছরে নগরীর অপরাধপ্রবণতা কমে আসছিল। হঠাৎ করে মাত্রাহীন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার এমন পরিস্থিতি নিজের জীবনে আর দেখেননি বলে জানান এ সংগঠক। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র আইনের সংস্কার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্রের জন্য বিচারে কোনো ছাড় না দিয়ে ন্যূনতম ১০ বছরের কারাদণ্ড নিশ্চিত হলে নিউইয়র্কের সড়কে অস্ত্র সহিংসতা কমবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ অফিসারদের সমন্বয়ে গঠিত নিউইয়র্ক নগরের অ্যান্টি-ক্রাইম ইউনিটকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ‘স্টপ অ্যান্ড ফ্রিক্স’ নামের শক্তিশালী নীতিকেও পরিত্যক্ত করা হয়েছে। এনওয়াইপিডি বাজেটের বিলিয়ন ডলার কাটছাট করেছেন মেয়র। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য অনেকে এটিকে কারণ হিসাবে দেখছেন। তবে আরেকটি কারণ হিসাবে উঠে এসেছে অপরাধীদের জামিন সংষ্কার আইন চালু হওয়ায়। নতুন এই আইনকে আহাম্মকের আইন আখ্যা দিচ্ছেন শান্তিপ্রিয় নগরবাসী। অনেকে বলছেন, এটি একটি চরম আত্মঘাতী আইন, যে আইনের কারণে হিংস্র সব অপরাধী কোনো জামিন ছাড়াই মুক্তি পাবে। অপরাধ ঘটানোর দিনেই ছাড়া পেয়ে যাবে। আর তাও এক পয়সার বন্ড ছাড়াই। আর এসব কারণে অপরাধ বাড়ছেই, মনে করেন অনেকেই।
শনিবার কুইন্সের করোনায় গোলাগুলির ঘটনায় এলাকাবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ এই গোলাগুলির সঙ্গে ত্রিনিটরিওস গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত ছিল। এ ঘটনার পর ডেমোক্রেটিক মেয়র প্রার্থী এরিক অ্যাডামস নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে গ্যাং এবং বন্দুকের বিরুদ্ধে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
সাবেক পুলিশ ক্যাপ্টেন এরিক অ্যাডামস নিউইয়র্ক সিটির অপরাধ দমনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পর্যাপ্ত হস্তক্ষেপ ছাড়া সহিংসতা আরও খারাপ হবে বলে মনে করেন তিনি। ভবিষ্যত মেয়র হিসাবে নগরবাসী এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে ত্রিনিটরিওসসহ অর্ধশতাধিক গ্যাং রয়েছে। সাম্প্রতিককালে এসব গ্যাং অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
Posted ৩:০৮ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৭ আগস্ট ২০২১
America News Agency (ANA) | ANA