সোমবার ১০ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫ কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এমন যুদ্ধ ইতিহাসও দেখেনি আগে

মুহম্মদ ফজলুর রহমান   |   শুক্রবার, ১০ জুলাই ২০২০   |   প্রিন্ট   |   789 বার পঠিত

এমন যুদ্ধ ইতিহাসও দেখেনি আগে

যুদ্ধ চলছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেশের সঙ্গে দেশের নয়। অক্ষ শক্তি-মিত্র শক্তি নেই। জার্মানি-অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-ইটালি-জাপান কিংবা ফ্রান্স-বৃটেন-আমেরিকা-রাশিয়া নেই। সব দেশ, অঞ্চল একদিকে একাকার। সমগ্র মানবসমাজ একপক্ষ। অন্যপক্ষে এক অদৃশ্য শক্তি। ভয়ঙ্কর সেই শত্রু করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। বিপুল বিক্রমে মানুষ নিধন করে চলেছে এই শত্রু। উজাড় করে দিচ্ছে জনপদ। করোনার সামনে অসহায় মানুষ। নিজেকে রক্ষার পথ জানা নেই। মানুষের মানুষ মারার মন্ত্র জানা আছে। হাতে করোনা বিনাশের কোন অস্ত্র নেই। শত্রুকে বোমা ছুঁড়তে হয় না। স্পর্শ করলেই মানুষ কাবু। এখন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ হত। আহত কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ইতিহাস এমন যুদ্ধ আগে কখনোই দেখেনি।
মানুষ বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ট্রিলিনয়-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে রাজকোষ শূন্য করে অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুললো, বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে আহার তুলে না দিয়ে। মানুষের ভাণ্ডারে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। এটম বোমা। হাইড্রোজেন বোমা। নাপাম বোমা। যুদ্ধ বিমান, টর্পেডো। ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন। যার যত ক্ষমতা, তার অস্ত্র ভাণ্ডার তত সমৃদ্ধ! শত্রু ঘায়েল করার তত আয়োজন পরিবেশ রুষ্ট করে, সভ্যতা ঝুঁকিতে ফেলে কেবল অস্ত্রের পেছনে মানুষের সব মেধা, সব জ্ঞান ব্যয় হয়েছে। পরিবেশ ও মানুষের জীবন রক্ষায় ব্যয় করার মতো সময় পাননি তারা।
এখন যেহেতু কারো পক্ষে বলার সাধ্য হচ্ছে না যে, এ যুদ্ধের শেষ কোথায়? তাই কিছুটা হলেও তাদের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কেউ জানে না এ যুদ্ধ নিষ্পন্ন হবে শত্রæপক্ষের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, নাকি সন্ধি করে?
মানুষের সামনে আজ যে শত্রু, তার কাছে মানুষের এইসব আয়োজন অর্থহীন। মানুষ সবই করেছে মানুষের বিরুদ্ধে। সবই মানুষ মারার আয়োজন। তাইতো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ আজ কত অসহায়! অস্ত্রভান্ডারের সব সমরাস্ত্র রেখে মানুষের অসহায় মৃত্যু দেখে যেতে হচ্ছে মানুষকে। অদৃশ্য শক্তি লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রের নিজেদের মতো করে গড়ে তোলা বিশ্বব্যবস্থা!
ইতিহাসে কেউ কি কখনো ভেবেছিলো- মানুষের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ ঘটবে অদৃশ্য এই শত্রুর কাছে? যার নাম- করোনাভাইরাস, কভোড ১৯। স্বেচ্ছাগৃহবন্দী। যুদ্ধে যেমন শত্রুর বয়স-লিঙ্গ বিচার নেই। ভাইরাস এই শত্রুরও লিঙ্গ-বয়স বিবেচনা নেই। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী-সক্ষম কারো নিস্তার নেই। যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরছে। সেই সঙ্গে স্থান-বিচারও নেই।
শুরু হয়েছিলো আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিপক্ষ সমাজতান্ত্রিক চীনে। চীনের হুয়ান নামক একটি অঞ্চলে। ধনবাদী শিবিরে হয়তো একটু একটু ভালই লাগছিল। প্রকৃতির প্রতিশোধ, দায় দেবে কাকে? কেউ কি তখন বুঝতে পেরেছিল- নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিপক্ষের দুর্গতি উপভোগ করা বেশিদিন চলবে না! করোনা কাউকে করুণা করতে আসেনি। কারো ঘরে আগুন দিয়ে অন্য কাউকে আলু পোড়া খাওয়ার সুযোগ দেবে না। করোনা দারুণ নিরপেক্ষ। ধর্মনিরপেক্ষ। বর্ণ নিরপেক্ষ। সম্প্রদায় নিরপেক্ষ। লিঙ্গ নিরপেক্ষ। বয়স নিরপেক্ষ। অঞ্চল নিরপেক্ষ। এমন কি বিশ্ব অর্থব্যবস্থার নিরপেক্ষও। এশিয়া জ্বলবে, ইউরোপ হাসবে, ইউরোপ জ্বলবে আমেরিকা হাসবে, তা হবে না। মুসলমান মরবে, হিন্দু হাসবে, কিংবা খৃস্টান মরবে বৌদ্ধ হাসবে, তাও হবে না। গোমূত্র, তন্ত্র-মন্ত্র, মোনাজাত-মাহফিলেও তাই কাজ হচ্ছে না। জাতি-ধর্ম, দেশি-প্রবাসী কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না।
মানব সভ্যতা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন অতীতে যেমন কখনো হয়নি, কখনো হতে পারে এমনটা কল্পনাও করেনি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কল্পনা করেনি মানে, কল্পনা করতে চায়নি। সবাই পরাশক্তি হওয়ার জন্য সবসময় নিত্যনতুন মারণাস্ত্র উদ্ভাবনের গবেষণায় মত্ত হয়েছিল। অর্থনৈতিক এবং সামরিক পরাশক্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় মানুষকে বাঁচানোর কথা ভুলে গিয়েছিল। মানবিক বিবেচনা থেকে দূরে সরে ছিল। তাইতো নিজ দেশের মানুষকে প্রকৃতির আক্রোশ থেকে বাঁচানোর, আজকের করোনার মত মানবসমাজের শত্রু কোন অদৃশ্য শক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কোন প্রস্তুতি, কোন গবেষণার প্রয়াস নেয়া হয়নি।
সব শক্তিমান দেশ- সে ধর্মবাদী হোক, সমাজবাদী-সাম্যবাদী হোক, ধর্মবিশ্বাসী হোক, কম্যুনিস্ট হোক- সবাই নিজে নিজে পরাশক্তি হতে চেয়েছে অন্য দেশের মানুষ মেরে। অন্য দেশ দখল বা ধ্বংস করে দিয়ে। নিজ দেশের মানুষের প্রতি অবহেলার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ৯/১১ এবং আজকের করোনাভাইরাসে আমেরিকার অসহায়ও।
আমেরিকা বাইরে যত পরাক্রমশালী হোক, দেশের ভেতরের মানুষ কত অরক্ষিত, কত অসহায়- সেই বাস্তবতার মুখোমুখি আমেরিকানরা যেমন হয়েছে, বিশ্বের মানুষও সেটা বুঝতে পেরেছে।
আমেরিকা তার সামরিক শক্তিরবলে কত সহজেই আফগানিস্তান, ইরাককে পরাস্ত, পর্যুদস্ত করেছে। আল কায়েদার মত সংগঠনকে আমেরিকা শিক্ষা দিতে পারে। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের এ্যাবোটাবাদের কোন গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে হত্যা করতে পারে। সাদ্দাম হোসেনদের মত একনায়কদের শায়েস্তা করতে পারে ইচ্ছা করলেই। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মত অদৃশ্য শত্রু, যে অলক্ষে মানবতাকেই ধ্বংস করে দিতে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা কখনো ভাবতেই চেষ্টা করেনি। আজ সেই অবহেলা-উদাসীনতারই পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে আমেরিকানদের এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকেই।
অনেক যুক্তিবাদী মানুষের মুখেও বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বলতে শোনা যায়-‘মানুষ বুঝি তার পাপ বা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ব করছে’। এসব যুক্তির বাইরে ভাগ্য-বিশ্বাসী কথা হলেও কখনও কখনও মানুষ ক্ষেপে গিয়ে যুক্তির বাইরেও কথা বলে। সেই কাজী নজরুলের মত- ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। আমরা আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে বহু অন্যায় করেছি এবং প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের ফল আজ নানাভাবে মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে উঠছে। ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সূর্যের বেগুনী রশ্মিতে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশের পারমাণবিক বর্জ্যরে কারণে নিত্য নতুন রোগেরও জন্ম হচ্ছে। রাষ্ট্রনায়করা কেউ ভাবছে কিনা যে, প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন মানুষ মারা যায়নি আমেরিকার। একটি বোমা ছাড়া কোন বোমা পড়েনি আমেরিকার মাটিতে। সন্ত্রাসী হামলায়, ৯/১১-এ এযাবৎকালে সর্বাধিক আমেরিকান নিহত হয়েছে।
এবার করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার সব দুর্যোগে প্রাণ হারানোর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমেরিকায়। আমরা সবাই আশাবাদী এই পরিস্থিতি আমরা পাড়ি দিতে সক্ষম হবো। প্রশ্ন- কতদিনে? এক সপ্তাহে, না এক বছরে? বর্তমান সময়ে যেকোন বিপর্যয়ে দুটি প্রশ্ন একসঙ্গে উঠে আসে : প্রাণহানী এবং অর্থনীতির ধস। আগেও আসতো। তবে যতটা প্রাণহানীর কথা আলোচিত হতো, অর্থনীতি ধসের কথা সেভাবে আসতো না। এখন প্রায় একই মাত্রায় উচ্চারিত হয়। যদিও আমরা বলি, জীবন আগে। জীবন অবশ্যই আগে। তবে বস্তবাদী এবং করপোরেট দুনিয়ায় এখন অর্থনীতি, মুনাফা সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়েও অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
আমরা জানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে। বহু ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও থেমেছে। এও বিশ্বাস করি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও অবসান ঘটবে। এবং এও বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত মানুষেরই বিজয় ঘোষিত হবে। কিন্তু মানুষের সেই বিজয় অর্জনের জন্য মানুষ মারার মারণাস্ত্র তৈরি করলে হবে না, এবার মানুষের অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাস থেকে মনুষ্য সমাজকে রক্ষার সেই শিক্ষাই নিতে হবে।
নইলে করোনা হয়তো করুণা করে বিদায় নেবে, কিন্তু মানুষের দুর্গতি-দুর্ভোগ শেষ হবে না। বিশ্ব সভ্যতা ও শান্তির প্রতি হুমকিও দূর হবে না। হয়তো অন্যকোন নামে, অন্য কোন সময়ে অন্য কোন অঞ্চলে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে। কে জানে, সেই যুদ্ধে কে বিজয়ী হবে? এবং পরিণতি কী দাঁড়াবে?
-‘কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। / এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’
মানবজাতির সামনে এমন কাণ্ডারী কে আছে!

লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।

Facebook Comments Box

Comments

comments

Posted ৩:০৮ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ জুলাই ২০২০

America News Agency (ANA) |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Dhaka University Centennial & New Beginnings
(13377 বার পঠিত)
স্বামী তুমি কার?
(12815 বার পঠিত)
দল বেঁধে সৈকতে
(1379 বার পঠিত)
[abm_bangladesh_map]
Editor-in-chief :
Sayeed-Ur-Rabb
Corporate Headquarter :

44-70 21st.# 3O1, LIC. New York-11101. USA,

06463215067

americanewsagency@gmail.com

Copyright © 2019-2025Inc. America News Agency (ANA), All rights reserved.ESTD-1997