মঙ্গলবার ১৫ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় উড়ছে টাকা* নিরাপত্তাহীনতায় সম্পত্তি বিক্রি করছেন প্রবাসীরা * দেশ ছাড়ছেন শিক্ষিত বেকাররা

উচ্চবিত্তের বিলাসী জীবন-বিদেশে সেকেন্ড হোম

এনা অনলাইন :   |   বৃহস্পতিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   12739 বার পঠিত

উচ্চবিত্তের বিলাসী জীবন-বিদেশে সেকেন্ড হোম

ঢাকায় টাকা উড়ছে’ -একসময় প্রবাদ বাক্য হিসাবে ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন তা বাস্তবে রূপলাভ করেছে। এখন ঢাকায় সত্যিই টাকা উড়ছে। যিনি ধরতে পারেন, তিনি রাতারাতি ধনী হচ্ছেন। উচ্চবিত্তের কাতারে নাম লেখাচ্ছেন। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন বিদেশে। প্রকৃত অর্থে দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঘুষ-দুর্নীতি বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হচ্ছে না দেশে। সরকারের কথিত জিরো টলারেন্স নীতি একপ্রকার মুখ খুবড়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, নিরাপত্তাহীনতায় দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন প্রবাসীরা। তারা হুন্ডিসহ নানা মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। কিনছেন বাসা-বাড়ি। সম্প্রতি নিউইয়র্কে প্রবাসীরা যত বাড়ি কিনছেন, বেশিরভাগই দেশের সম্পতি বিক্রি করে কিনেছেন বলে এক অনুসন্ধানে জানা গেছে।

একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে উন্নয়ন যেমন ত্বরান্বিত হচ্ছে, তেমনি সুশাসনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সর্বত্রই অনিয়ম-অব্যবস্থা রাষ্ট্রকে পেয়ে বসেছে। ভবিষ্যত বাংলাদেশ কোনপথে যাবে তা এখনই অনুমান করা যায়। এসব বিবেচনায় রেখেই প্রবাসীরা দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা বলছেন, একসময় বিদেশের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দেশে সম্পত্তি বাড়িয়েছেন। অট্টালিকা গড়ে তুলেছেন। এখন সেই সম্পত্তি বিক্রি করতে একবারও চিন্তা করছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবাসী জানান, অপেক্ষাকৃত কমদামে তিনি গুলশানের বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন। মুহূর্তের মধ্যে একজন ব্যবসায়ী রাজনীতিক সেটি কিনে নিয়েছেন। সেই টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে নিউইয়র্কে এনেছেন। এরপর এখানেই বাড়ি কিনেছেন। তিনি বলেন, আমার মত অনেকেই এখন দেশের সম্পত্তি বিক্রি করছেন।

নারায়ণগঞ্জ প্রবাসী এক তরুণ জানান, গ্রামের বাড়িতে তার মায়ের নামে একটি সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। ভূয়া দলিল করে একজন প্রভাবশালী সম্পত্তির দখল নিয়েছেন। আদালতেও গিয়েছিলেন। কোনো ফল আসেনি। ভয়ে এখন অন্য সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, তাদের অন্য সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা নিউইয়র্কে নিয়ে যাবেন। এরপর বাড়ি কিনবেন। ওই তরুণ জানান, সুশাসন নিশ্চিত না হলে প্রবাসীরা দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন।

এদিকে দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও চাকরি মিলছে না। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ দিন দিন কমছে। ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর এসব বেকাররা শেষ চেষ্টা হিসাবে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। খরচ মেটাতে বিক্রি করে দিচ্ছেন পৈত্রিক সম্পত্তি।

সম্প্রতি স্টুডেন্ট ভিসায় বহু তরুণ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছেন। ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস স্টুডেন্ট ভিসা বাড়িয়েছে। তবে কাজের অনুমতি না থাকায় এসব স্টুডেন্টরা আর্থিক অনটনে রয়েছেন। তারপরও এসব শিক্ষার্থীরা বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পেরে খুশী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক তরুণ জানান, অনেক আগেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করেছেন। কিন্তু চাকরি পাচ্ছিলেন না। কতদিন বেকার থাকবেন, এই চিন্তায় ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসেছেন। এখন সাময়িক কষ্ট হলেও একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। তবুও দেশের অনিশ্চিত জীবন তাদের বিষণ্ন করে তুলছিল।

এদিকে, দেশে একটি গোষ্ঠী যখন অনিশ্চয়তায়, তখন ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে আরেকটি গোষ্ঠী। তারা জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন। অনেকে বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন। বিদেশে বাড়ি গাড়ির খবর এখন হরহামেশা বের হচ্ছে। এসব খবরও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।

বৈশ্বিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সেবা খাতের দুর্নীতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। আর যারা সেবা দিচ্ছেন তারা ঘুষের টাকার পাহাড় গড়ছেন। বরং দুর্নীতি প্রতিরোধে অনুমতি ছাড়া গ্রেপ্তার না করারও আইন আছে দেশে।
টিআইবির জরিপ অনুযায়ী- দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। তালিকায় এর পরে রয়েছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা ও শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত)। এছাড়া ঘুষ নেওয়ার দিকে থেকে তালিকার প্রথমে রয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। বিদেশ যেতে গিয়ে বেকার যুবকেরা সবার আগে তৈরি করেন পাসপোর্ট। আর জীবনের প্রথম পাসপোর্টটি করতে গিয়ে তারা ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। পাসপোর্ট অফিসের দরজা-জানালা ঘুষ খায়, এমন প্রবাদ চালু আছে দেশে।

টিআইবির জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট ১৭টি সেবা খাতে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে সরকারি-বেসরকারি খাতের কোনো সেবাই মিলছে না। সাধারণ মানুষ সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুষ, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাব বিস্তার, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ভূমি ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি হচ্ছে। এসব খাতে ঘুষ-দুর্নীতি হচ্ছে প্রকাশ্যে। মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে গেলেও কোনো কাজ হয় না ঘুষ না দিলে।

সম্প্রতি একজন নিউইয়র্ক প্রবাসী মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে ঢাকার একটি ভূমি অফিসে গিয়েছিলেন। ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা মন্ত্রীর সুপারিশ পেয়ে তাকে আপ্যায়নও করেছেন। কিন্তু যে কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন তার জন্য শুধু খরচাপাতি চেয়ে বসেন। ওই কর্মকর্তা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে মন্ত্রী বলে দিয়েছেন বলেই তার কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। এজন্য খরচাপাতি লাগবে। নিরূপায় হয়ে অবস্থা বুঝতে পেরে ওই প্রবাসী টাকার বিনিময়ে দফারফা করে তার কাজটি সেরে চলে আসেন।

শুধু ভূমি খাত নয়, স্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা খাতের দুর্নীতির চিত্র আরো ভয়াবহ। এই খাতে চাকরি মানেই টাকার বিছানায় ঘুমানো। টিআইবি বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তাদের একটি অংশের সঙ্গে যোগসাজশ করে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটন করে থাকে। নিরপরাধ, নিরীহদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি এমন অভিযোগও রয়েছে যে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলে অপরাধ সংঘটনকারীর পক্ষ হয়ে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা রেকর্ড করতে চায় না। এক কথায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের বিরুদ্ধে জনগণকে নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। এসব হয়রানির পেছনে অর্থ আদায়ের স্বার্থই মুখ্য।

পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও বিআরটিএর বিরুদ্ধেও জনগণের অভিযোগের শেষ নেই। পাসপোর্ট অফিসের দালালচক্রের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আঁতাত সর্বজনবিদিত আর বিআরটিএর দুর্নীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যাধিক্যে।

সরকারি স্বাস্থ্যসেবার দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত যে কী পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত সেটা দেশে করোনা মহামারি আসার পর থেকে মানুষ দেখেছে। ভূমি সেবা হলো দুর্নীতির আখড়া। এখানে সেবা নিতে গেলে মানুষ কী পরিমাণ হয়রানি হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালে সরকার যখন নাগরিকদের জন্মনিবন্ধন অনলাইনকরণ করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল এবং সেটার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করে দিয়েছিল তারপরও মানুষকে সেখানে অতিরিক্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। আর হয়রানি তো আছেই।

দুর্নীতি এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। এমন কোনো সেবা খাত নেই, যেখানে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি হচ্ছে না। টিআইবি দুর্নীতি রোধে ১০ দফা সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি দমন কমিশনকে সক্রিয় করা, বিভিন্ন সেবা ডিজিটালাইজ করা, ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে গণশুনানির আয়োজন করা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। দুর্নীতি নির্মূলে টিআইবির এসব সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু যারা দুর্নীতি দমন করবে, সেই দুর্নীতি দমন কমিশন ‘নখদন্তহীন বাঘ’ হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে, আর সবাই ছুটতে টাকার পেছনে-এমন মন্তব্য করতে শোনা যায় ভুক্তভোগী মহলকে।

–ঠিকানা

Facebook Comments Box

Comments

comments

Posted ১:০৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

America News Agency (ANA) |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

[abm_bangladesh_map]
Editor-in-chief :
Sayeed-Ur-Rabb
Corporate Headquarter :

44-70 21st.# 3O1, LIC. New York-11101. USA,

06463215067

americanewsagency@gmail.com

Copyright © 2019-2025Inc. America News Agency (ANA), All rights reserved.ESTD-1997