এনা অনলাইন : | মঙ্গলবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 768 বার পঠিত
অমর একুশে গ্রন্থমেলার। ঘড়ির কাঁটায় ৩টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই খুলে দেয়া হয় মেলার দ্বার। ঢল নামে বইপ্রেমীদের। বইপোকা পাঠকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বইমেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশ। বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ক্রেতা দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়া মতো। স্টলগুলোতে আসছে নতুন নতুন বই, সেই সঙ্গে বাড়ছে মেলার বেচাকেনাও।
বইপ্রেমীদের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে বই বিক্রির পরিমাণও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বইপটুরা এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে কিনছেন পছন্দের লেখকদের বই। কেউবা খোঁজ নিচ্ছেন প্রিয় লেখকের বই এসেছে কিনা, আবার কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরতেও এসেছে। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাও যুগলবন্দি হয়ে এসেছেন মেলায়। এ দিকে মেলায় অন্য দু’দিনের চেয়ে ধুলার উড়াউড়ি ছিল কম। স্টল গোছানোর কাজও এখনো শেষ করতে পারেননি প্রকাশকরা। জমেনি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের লিটন ম্যাগ কর্র্নারও।
গতকাল বিকেলে বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হলেও বইপ্রেমীদের ভিড় ছিল চোখের পড়ার মতো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করে ভিড়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্টল ঘুরে খুঁজছেন পছন্দের লেখকের বই। আবার অনেকে ক্রয় না করে বই দেখে যাচ্ছেন। নিজের বইয়ের প্রচার ও প্রসার বাড়াতে এসেছেন বইয়ের লেখকও। নিজ বইয়ের স্টলে সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলছেন, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আবার ছবিও তুলছেন। মেলায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় এবারের বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি কাজী রোজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফুল পরীদের মতো, জীবন পাখির মতো, মানুষদের নিয়ে ওড়াউড়ি করছে, ঘোরাঘুরি করছে বইমেলা। এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে।’
বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু কম্পিউটারে বসে থাকবে না। সবাই মেলায় আসবে, সবার হাতে হাতে বই থাকবে, সবাই বই কিনবে, সবাই বই পড়বে।’
বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নোয়াখালী থেকে মেলায় এসেছে সোনাইমুড়ী সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নম্রতা দাশ প্রিয়া। কথা হয় প্রিয়ার সঙ্গে। প্রিয়া বলে, ‘আমার প্রিয় লেখক জাফর ইকবাল। তার বই কেনার জন্যই বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছি। জাফর ইকবাল স্যারের ৬টি বই কিনেছি। আরো কিছু বই কিনব।’
রাজধানীর বাড্ডা থেকে বই মেলায় এসেছেন রবির কর্মকর্তা রুশদি। রুশদি বলেন, ‘গত বছর থেকে এ বছরের মেলা আমার কাছে খুবই প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি থেকে কিছু বই কিনেছি। আরো কিনব।’
এবারের মেলায় পরিবেশ দেখে খুশি মেলায় আসা বইপ্রেমীরা। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষার্থী তিন বান্ধবী একসঙ্গে এসেছেন বইমেলায়। আশরাফি রহমান, কানিজ ফাতেমা, রাইদা নামের ওই তিন বান্ধবী বলেন, ‘সাজানো গোছানের ক্ষেত্রে এবারের বইমেলা অন্যবারের চেয়েও অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। স্টল, প্যাভিলিয়নগুলো এবারের মেলার সৌন্দর্য বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।’
কথা প্রকাশের বিক্রয়কর্মী নাহিম আহমদ বলেন, ‘গত দুই দিন ক্রেতারা এসে বই দেখে গেছেন। তবে আজ গত দুই দিনের চেয়ে বিক্রি বেশি হয়েছে।’
ভাষাচিত্রের বিক্রয়কর্মী তানভীর ও দৃষ্টি বলেন, ‘বিক্রি ভালো হয়েছে। এত বিক্রি হবে আমরা প্রত্যাশাও করিনি। মানুষের যেভাবে সে াত বাড়ছে, আশা করছি এবারের বই বিক্রির সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ভাঙবে।’
এ দিকে গতকাল বিকেলে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বর ঘুরে দেখা গেছে শিশু চত্ব¡রেও রয়েছে উপচেপড়া ভিড়। অভিভাবকদের সঙ্গে মেলায় এসেছে চত্বরের বিভিন্ন খেলাধুলা সামগ্রী পেয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে তারা। কেউ কেউ বাবা-মায়ের হাত ধরে বিভিন্ন স্টল ঘুরে কিনেছেন বই।
শিশুরাজ্যের বিক্রয়কর্মী আক্কাছ খান বলেন, ‘মেলায় শিশুদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শিশুদের উপস্থিতি বাড়ার সঙ্গে বই বিক্রিও বাড়ছে।’
মায়ের হাত ধরে মেলায় এসেছে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী শান্তা মারিয়া। সে বলে, ‘মেলায় অনেক ভালো লাগে। মা কয়েকটি গল্পের বই কিনে দিল। আরো কিনে দিবে বলেছে।’
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী টুম্পা দাস বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে গতকাল মেলায় এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখন দেখছি। ভালো বইগুলোর তালিকা করছি। তবে খুব ভালো বই পেলে কিনে নেব।’
অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমদ বলেন, ‘অন্য দু’দিনের চেয়ে আজ (গতকাল) ধুলাবালির পারিমাণ কম ছিল। আজকালের মধ্যে ধুলাবালি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘মেলার অসঙ্গতিগুলো তালিকা করে তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি অন্য বছরের চেয়ে এ বছরের মেলা সৌন্দর্যবর্ধিত হবে।’
অন্যদিকে গতকাল বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। বলা হয়ে থাকে ঊনসত্তর না হলে সত্তরের নির্বাচন হতো না আর সত্তর না এলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও হতো না। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আরো প্রলম্বিত হতো- অধিকারহারা মানুষকে হয়তো জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হতো।’
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অত্যন্ত গুরুত্ববহ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের এক বৃহৎ প্রস্তুতিপর্ব এই গণঅভ্যুত্থান। মুক্তিযুদ্ধের মর্ম অনুধাবন করতে হলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের বিশদ বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।’
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি রবিউল হুসাইন এবং আলতাফ হোসেন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম ও ঝর্ণা সরকার। সংগীত পরিবেশন করেন ফাহিম হোসেন চৌধুরী, সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, আবদুর রশিদ এবং নূসরাত বিনতে নূর। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন সুবীর চন্দ্র ঘোষ (তবলা), সুনীল কুমার সরকার (কী-বোর্ড), নাজমুল আলম খান (মন্দিরা) এবং অসিত বিশ্বাস (এসরাজ)। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলাপনে অংশ নেন আবুল কাশেম, দিলদার হোসেন, শামীম রেজা, অদিতি ফাল্গুনী এবং কৌস্তুভ শ্রী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাহবুবা রহমান।
নতুন বই: গতকাল মেলায় ১৩৮টি নতুন বই এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ অফিস। এর মধ্যে মধ্যে গল্প ২০টি, উপন্যাস ২০টি, প্রবদ্ধ ১৫টি, কবিতা ২০টি, গবেষণা ৪টি, ছড়া ৮টি, শিশুসাহিত্য ১০টি, জীবনি ৬টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৬টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ২টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৩টি, ইতিহাস বিষয়ক ৫টি, রাজনীতি বিষয়ক ৩টি, স্বাস্থ্য বিষয় ৩টি, রম্য ১টি, অনুবাদ ২টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি, অন্যান্য ৮টিসহ মোট ১৩৮। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোস্তফা মনোয়ারের গণিত বিষয়ক বই ‘গণিতের গতিময় দাদাগিরি’, মোহিত কামালের উপন্যাস ‘সত্যজানা সন্দেহপালক’, জলতরঙ্গ প্রকাশনী এনেছে সোলায়মান শিপনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘জোনোসাইড’, শোভা প্রকাশ এনেছে তারেক শামছুর রহমানের প্রবদ্ধ ‘মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস ‘যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু, বিভাস প্রকাশনী এনেছে নির্মলেন্দু গুণের ‘ভ্রমণ সমগ্র।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ অমর একুশে গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন নূহ-উল-আলম লেনিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুভাষ সিংহ রায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমেদ এমপি। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
Posted ৪:৪৭ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
America News Agency (ANA) | Payel