‘সিলট আমার সিলট তোমার/সিলট গলার মালারে…/বাবা শাহজালালের দেশ/ সিলট ভূমিরে,/ বাবা শাহ পরাণের দেশ/ সিলট ভূমিরে,/ সুরমা নদীর তীরে/আমার ঠিকানা রে’- মমতামাখা কণ্ঠে রেকর্ডকৃত দেশাত্মবোধক গানটি যখন স্পিকারে ধ্বনিত হলো, তখন মনে হচ্ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে সশরীরে অবস্থান করলেও মুহূর্তের জন্যও তারা বিস্মৃত হননি নিজেদের জন্মমাটি, শাহজালাল-শাহপরাণসহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট থেকে। ইস্ট রিভারের তীরঘেঁষা নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া পার্কটিকে আচমকাই মনে হলো যেনো সুরমা পারের কোনো এক প্রকৃতিকন্যা।
আবার বিশ্ব মাতানো সিলেটের সেই আঞ্চলিক গান ‘আইলারে নয়া দামান/ আসমানেরও তেরা/ বিছানা বিছাইয়া দিলাম/ শাইল ধানের নেরা/ দামান্দ বও দামান্দ বও/ও দামান্দ বও দামান্দ বও/ বও দামান কওরে কথা/ খাওরে বাটার পান/ যাইবার কথা কও যদি/ কাইট্টা রাখমু কান’-এর ছন্দে-তালে যখন সিলেটি নারী-পুরুষ-শিশুরা মাতোয়ারা, তখন মনে হলো এ যেনো নিউইয়র্ক নয়, একখণ্ড সিলেট! গানটির সাথে অপরূপ নৃত্যের তালে তালে দুই সিলেটি শিল্পী দর্শক-শ্রোতাদের এতটাই মুগ্ধ করেন যে, একসময় একে একে সবাই শিল্পী বনে গিয়ে গানটিতে কণ্ঠ মেলান, আর সমানতালে অনেকেই নাচতে থাকেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার এই নাচন দেখে নিউইয়র্কের গুমোট আকাশের মনেও যেন খুশির দোলা লাগে! সকাল থেকেই মন ভারী করে থাকা আকাশটা যেন খানিক সময়ের জন্য রোদের ঝলকানি ছড়িয়ে দিয়ে এই উৎসবে গা মাতায়।
বলা হচ্ছে নিউইয়র্কে বসবাসরত সিলেটবাসীর সংগঠন- সিলেট সদর থানা অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার বার্ষিক বনভোজনের বিষয়ে। গত ১৮ জুলাই এস্টোরিয়া পার্কে এই বনভোজন অনুষ্ঠিত হয়। বছরাধিককাল অভিশপ্ত করোনার করালগ্রাসে ঘরবন্দী থেকে হাঁফিয়ে ওঠা সিলেটবাসীর কাছে এই বনভোজন ছিল অনেকটা শেকলভাঙার অস্ত্র। তাই আমন্ত্রণ পেয়ে দলে দলে সিলেটিরা সপরিবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন বনভোজনে। বাঙালি নারীর অহংকার শাড়ি পরে নারীরা অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হওয়ায় এর চাকচিক্য বেড়ে যায় হাজার গুণ। আর শিশুদের বাঁধভাঙা উল্লাস দেখে এতদিনের বন্দিজীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যান মা-বাবারা। একটা সময় সেটা আর বনভোজনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরিণত হয় সিলেটিদের মিলনমেলায়, উৎসবে। আয়োজকেরাও একে রূপ দেন উৎসবের আদলেই। বনভোজনের শাহি ভোজনপর্ব তো ছিলই, সঙ্গে ছিল অতিথিদের মনোরঞ্জনের যাবতীয় আয়োজন। নাচ-গান, খেলাধুলা, পুরস্কার বিতরণী, র্যাফল ড্র- কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। আর খাওয়াদাওয়াসহ সব পর্বেই ছিল সিলেটি আভিজাত্যের ছাপ। ঐতিহ্যগতভাবে অতিথিপরায়ণ সিলেটবাসীর এই বনভোজনে আতিথ্যটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। যে কারণে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সব অতিথি আয়োজকদের সব আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করতেও ভোলেননি।
ওইদিন এস্টোরিয়া পার্কে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বনভোজনের সূচনা হয়। সিলেট সদর থানা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল মালেক খান লায়েক, সাধারণ সম্পাদক দুরুদ মিয়া রনেল, সহসভাপতি শাহনেওয়াজ কোরেশি ও মুকুল হক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মেহরাজ ফাহমী ও আব্দুল ওয়াদুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক টিটু আহমেদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ আহমেদ, প্রচার সম্পাদক রাজীব খান, ক্রীড়া সম্পাদক মিনহাজ চৌধুরী এবং সদস্য নাসিম চৌধুরী, মাহবুব রহমান, জয়দেব জয় আগত অতিথিদের স্বাগত ও ধন্যবাদ জানান। এরপর শুরু হয় ভোজনপর্ব। পরে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শেষে বিভিন্ন ইভেন্ট ও র্যাফল ড্রতে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আকর্ষণীয় সব পুরস্কার।
বনভোজনে সিলেট সদর থানা অ্যাসোসিয়েশনের ১৯৯৫ থেকে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- প্রফেসর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ঠিকানার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন, অ্যাসেম্বলিম্যান ডেভিড ওয়েপ্রিন, নবনির্বাচিত কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট জজ সোমা সাঈদ, বিশিষ্ট রাজনীতিক বাবরুল হোসেন বাবুল, ডা. মাসুদ হাসান, আওয়ামী লীগ নেতা কয়েছ আহমেদ, নারীনেত্রী রানা ফেরদৌস, প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট শেকিল চৌধুরী, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ডিসিসির সাবেক কাউন্সিলর ডেইজি সরোয়ার, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মইনুল হক চৌধুরী হেলাল, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন কানাডা শাখার সভাপতি দেবব্রত দে তমাল, জেএমসির সাধারণ সম্পাদক মনজুর চৌধুরী, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুকিত চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, লেখক সুব্রত বিশ্বাস, সাবেক ছাত্রনেতা শাহাব উদ্দিন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কল্লোল আহমেদ, ইত্যাদি গ্রোসারির কর্ণধার আবু নোমান শাকিল, ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান বেদারুল ইসলাম, বিয়ানীবাজার সমিতির সাবেক সভাপতি মাসুদুল হক সানু, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন আফজাল, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানূর রহমান, সহ-সভাপতি জোসেফ চৌধুরী, মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট সোসাইটির সভাপতি তজমুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মেদ জাবেদ উদ্দিন, কমিউনিটি লিডার আক্তার রহমান টিপু, ফেডেলিস কেয়ারের কমিউনিটি বিষয়ক কর্মকর্তা ওমর ফরিদী, মোশায়েদ রাশেদ, বিশিষ্ট কমিউনিটি লিডার আসিফ চৌধুরী, পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, টাইম টিভির সিইও আবু তাহের, প্রথম আলো নর্থ আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন, সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, কবি ইশতিয়াক আহমেদ রূপু, মনিজা রহমান, এইচ বি রিতা, কমিউনিটি লিডার ফক্কু চৌধুরী, তোফায়েল চৌধুরী, এস্টোরিয়া সোসাইটির সভাপতি সোহেল আহমেদ প্রমুখ।
অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সুন্দর পরিবেশে বনভোজনের প্রতিটি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় অতিথিরা আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা দেন।
Posted ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১
America News Agency (ANA) | ANA