কয়েক বছর ধরে গড়ে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার নিট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে দেশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই এসেছে ২৫৮ কোটি ৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরে মোট এফডিআই ছিল ৩২৯ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার, যার ৩৫ শতাংশই এনেছে ১০টি প্রতিষ্ঠান। আর এ ১০ প্রতিষ্ঠানের মোট এফডিআইয়ের ৫৬ শতাংশই এসেছে তিন কোম্পানির সুবাদে।
এফডিআই প্রবাহে শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। বাংলাদেশ-চীন যৌথ এ উদ্যোগের পরই মোট এফডিআই আকর্ষণে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নরওয়েভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। তৃতীয় অবস্থানে আছে জাপানভিত্তিক ওয়াইকেকে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড।
এফডিআইয়ে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নতুন সংযোজন বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে বেশ আগে থেকে। গত অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট এফডিআই এসেছে ১১৭ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ডলার। এ হিসাবে মোট এফডিআইয়ের ৩৫ শতাংশই এনেছে ১০টি প্রতিষ্ঠান।
তবে এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের সিংহভাগই মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ ও ইন্ট্রা-কোম্পানি ঋণ হিসেবে এসেছে। নিট মূলধন বা ইকুইটি বাবদ আসা এফডিআই ২০ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে এফডিআই প্রবাহের এ চিত্র উঠে এসেছে।
দেশে নিবন্ধিত যৌথ ও শতভাগ বিদেশী মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর এন্টারপ্রাইজ সার্ভে বা সমীক্ষার ভিত্তিতে এফডিআই পরিসংখ্যান সংকলন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিট নিজস্ব মূলধন বা ইকুইটি, পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় বা রিইনভেস্টেড আর্নিং ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ বা ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন— এ তিন ভাগে হিসাব করা হয় এফডিআই প্রবাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সমীক্ষার আওতায় থাকা যৌথ অথবা শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগের বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৪০০। এর মধ্যে সমীক্ষায় সাড়া দিয়েছে ১ হাজার ৭০০টি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ২৫৮ কোটি ৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার নিট এফডিআইয়ের মধ্যে নিট ইকুইটি বা মূলধন ছিল ৬১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ১২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ হিসেবে এসেছে ৭১ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবে গত বছর দেশে মোট এফডিআইয়ের প্রায় ৪৯ শতাংশই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আয়ের পুনর্বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি এফডিআই এনেছে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ-চীন যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। গত অর্থবছর আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ছিল ৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই ছিল নরওয়েভিত্তিক টেলিযোগাযোগ জায়ান্ট টেলিনরের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ১৩ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার ডলার মোট এফডিআইয়ের পুরোটাই পুনর্বিনিয়োগকৃত আয়।
এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, টেলিযোগাযোগ একটি বিনিয়োগনির্ভর সেবা খাত। সর্বোচ্চ মানের গ্রাহকসেবা ধরে রাখতে গ্রামীণফোন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আসছে। ফলে সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে। গ্রাহকের জন্য সেবার সর্বোচ্চ মান ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন ডিজিটাল সার্ভিস চালু করতে গ্রামীণফোন ভবিষ্যতেও বিনিয়োগের এ ধারা অব্যাহত রাখবে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ১২ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার এফডিআই এসেছে জিপার প্রস্তুতকারক কোম্পানি ওয়াইকেকে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে। তবে চীনভিত্তিক বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির মতো আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ হিসেবেই এসেছে জাপানভিত্তিক ওয়াইকেকের এফডিআই।
গত বছর এফডিআইয়ের চতুর্থ সর্বোচ্চ তহবিলটি এসেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে। গত অর্থবছর ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠানটির এফডিআই ১১ কোটি ৮৬ লাখ ১০ হাজার ডলার, যার প্রায় পুরোটাই এসেছে প্রতিষ্ঠানের আয়ের পুনর্বিনিয়োগ বাবদ।
মোট এফডিআইয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে জিন চ্যাং সুজ (বিডি) লিমিটেড। চীনভিত্তিক পাদুকা বা ফুটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছর দেশে বিনিয়োগ করেছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ অর্থের প্রায় পুরোটাই আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ হিসেবে এসেছে।
২০১৬ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গোটানোর প্রস্তুতি শুরু করে তেল-গ্যাস খাতের মার্কিন জায়ান্ট শেভরন। পরবর্তী সময়ে একটি চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে এ নিয়ে চুক্তিও করে শেভরন। তবে প্রস্থানের কথা বললেও গত অর্থবছর দেশে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ এফডিআই এনেছে শেভরন বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ৮ কোটি ৭৩ লাখ ২০ হাজার ডলার বিনিয়োগের ৭১ শতাংশই নিট মূলধন বা ইকুইটি।
এফডিআইয়ে শীর্ষ ১০ তালিকার সপ্তম অবস্থানে রয়েছে দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড (এইচএসবিসি)। গত অর্থবছর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসা ৬ কোটি ৭৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার এফডিআইয়ের প্রায় পুরোটাই পুনর্বিনিয়োগকৃত আয়। এফডিআই প্রবাহ বিচারে এইচএসবিসির পর রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ইডটকো। গত অর্থবছর ৫ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার এফডিআই এনেছে ইডটকো। এ প্রবাহের প্রায় পুরোটাই নিট মূলধন বা ইকুইটি। নবম অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠান হলো বিদ্যুৎ খাতের অ্যাগ্রেকো পাওয়ার বিডি লিমিটেড। গত অর্থবছর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ১০ হাজার ডলার এফডিআই প্রবাহের ৬৪ শতাংশই আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ। এফডিআই প্রবাহে দশম অবস্থানে রয়েছে কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড। বিশ্বখ্যাত কোকা-কোলা প্রস্তুতকারকের বাংলাদেশ প্রকল্পটি গত অর্থবছর এফডিআই এনেছে ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যার পুরোটাই নিট নিজস্ব মূলধন বা ইকুইটি বাবদ আসা প্রবাহ।
গত অর্থবছর সর্বোচ্চ এফডিআই আকর্ষক বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থারমাল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের সুবাদেই কোম্পানিটির এ বিনিয়োগ দেশে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী এবং পায়রা থারমাল পাওয়ার প্লান্টের প্রকল্প পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা বণিক বার্তাকে বলেন, চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণের একটি অংশ হিসেবে গত অর্থবছরে অর্থ এসেছে বাংলাদেশে। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থারমাল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের নিমিত্তেই এ অর্থ এসেছে। প্রকল্পটিতে দরকার ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, তারই অংশ হিসেবে ৪০ কোটির কিছু বেশি ডলার গত অর্থবছরে নিয়ে আসা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
দেশে বিদেশী বিনিয়োগের স্বল্পতা ও অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম. আমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো শিল্প হতে সময় প্রয়োজন দু-তিন বছর। এ বছর যে বিনিয়োগ নিবন্ধনের তথ্য আমরা পাচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নে দু-তিন বছর লাগবে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হতে দু-তিন বছর লেগে যাবে। বিদেশী বিনিয়োগের যে কেন্দ্রীভবন দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বাণিজ্য বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়ে গেছে। আমাদের রফতানি গন্তব্য ও বিদেশী বিনিয়োগের উৎস দেশগুলোর মধ্যেও এ কেন্দ্রীভবন আছে। এজন্য দায়ী আমরাই। আমরা পোশাক খাত উন্নয়নে যে ধরনের উদ্ভাবনী নীতি তৈরির পারদর্শিতা দেখিয়েছি, সেই পারদর্শিতা অন্য খাতে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
Posted ১০:৫০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮
America News Agency (ANA) | Payel