চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ৮২৫ কোটি রুপি নিট লোকসান দিয়েছে ভারতের আদানি পাওয়ার। আদানি পাওয়ারের মতোই লোকসানে রয়েছে দেশটির আরো কিছু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত এ লোকসান। এর চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থায় আছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন, ইউরোপ ও রাশিয়ার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এর মধ্যে রাশিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রয়েছে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায়। সেখানে কয়লা পুড়িয়ে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে লোকসান হয় ১২ ডলার করে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ লোকসানের পরিমাণ যথাক্রমে ৩ ও ৪ ডলার।
গোটা বিশ্বেই এখন সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত। জ্বালানি খাতের ফিন্যান্সিয়াল থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান লন্ডনভিত্তিক কার্বন ট্র্যাকারের গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গোটা বিশ্বের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন লোকসানে চলছে। কার্বন প্রাইসিং ও বায়ু দূষণ প্রতিরোধসংক্রান্ত ইতিবাচক নানা পদক্ষেপের কারণে ২০৪০ সালের মধ্যে এ হার বেড়ে দাঁড়াবে ৭২ শতাংশে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জোর দিচ্ছে। এর আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ মোট জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার অবদান বর্তমানের ৩ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে সরকারি, বেসরকারি ও জয়েন্ট ভেঞ্চারে কয়লাভিত্তিক ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত সক্ষমতা ২০ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট। বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লাই হবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির উৎস। তবে এখন পর্যন্ত পায়রা, রামপাল ও মাতারবাড়ী— এ তিনটি ছাড়া অন্য কোনো প্রকল্পে তেমন একটা অগ্রগতি নেই।
বৈশ্বিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সার্বিক মুনাফা সক্ষমতা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে বিশ্বব্যাপী মোট ৬ হাজার ৬৮৫টি কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে কার্বন ট্র্যাকার। কার্বন ট্র্যাকারের ভাষ্য অনুযায়ী, আগে যেখানে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো, সেখানে এখন কীভাবে লোকসান সংকোচনের মাধ্যমে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এখানে ব্লুপ্রিন্ট আকারে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক, বিনিয়োগকারী ও সিভিল সোসাইটির জন্য ওই বিষয়েই একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে এর বিপরীতে বায়ু ও সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয় দিন দিন আরো কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে ৩৫ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয় নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যয়ের তুলনায় কম। ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমানের ৯৬ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন খরচ হবে নবায়নযোগ্য নতুন জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যয়ের তুলনায় বেশি।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতাকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভরতায় রূপান্তরের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করা যাবে বলে কার্বন ট্র্যাকার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এতে বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে সমসক্ষমতার নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে শুধু চীনেই সাশ্রয় করা যাবে ৩৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর এ সাশ্রয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও ৭ হাজার ৮০০ কোটি ও রাশিয়া ২ হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় করতে পারবে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলক উদার বাজার ব্যবস্থায় ইউটিলিটি সেবা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শেয়ারহোল্ডারদের সম্পদ অকার্যকরতার ঝুঁকিতে ফেলে দেয় বলে প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্থানে, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেখানে এ ধরনের ঝুঁকি বেশি। এক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি সহায়তা না পাওয়া গেলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে অথবা পরিবেশ নীতিমালার বাস্তবায়ন ধীর বা বন্ধ করে দিতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ন্ত্রিত বাজারের দেশে কয়লায় বিনিয়োগের ঝুঁকি সাধারণত রাষ্ট্রই বহন করে থাকে। এক্ষেত্রে কয়লাকে প্রতিযোগিতার ঝুঁকি থেকে এক ধরনের সুরক্ষা দেয়া হয়। চীন, ভারত, জাপান ও আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় সাধারণত ভোক্তার উপরেই চাপিয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে এভাবে কয়লার পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে তা অর্থনৈতিক প্রতিযোগী সক্ষমতা ও পাবলিক ফিন্যান্সকে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। কারণ এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা ভর্তুকি দিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ভোক্তাদের বিদ্যুৎ ব্যয়— এ দুয়ের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হবেন।
কার্বন ট্র্যাকার বলছে, বিভিন্ন দেশের সরকারের উচিত হবে এখন ক্রমান্বয়ে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক উপযোগিতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আগে বন্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত। যেহেতু নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যয় তুলনামূলক কম, সেহেতু সরকারগুলোর উচিত হবে কয়লায় বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও লাতিন আমেরিকার একাংশের সরকারগুলোর কাছে এরই মধ্যে এ ধরনের যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ বৈশ্বিক প্রবণতার প্রভাব বাংলাদেশে তেমন একটা পড়বে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে কার্বন ট্যাক্স নেই। এছাড়া বিদেশে জ্বালানির দাম বাড়লেই যখন-তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যায় না, যেটা বাংলাদেশে করা যায়। ফলে এক্সটারনাল কোনো চাপ নেই। এছাড়া ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট (আইপিপি) ছাড়া বাংলাদেশে অধিকাংশ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো এমনিতেই লোকসানে চলছে।
সূত্র : বণিক বার্তা
Posted ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০১৮
America News Agency (ANA) | Payel