খোন্দকার মোজাম্মেল হক : | শুক্রবার, ০৯ অগাস্ট ২০১৯ | সর্বাধিক পঠিত
বাঙালি জাতির শত-শতাব্দীর ইতিহাসে যা কিছু অর্জন, তার সবই এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, বাঙালি জাতি ছিল পরাধীন। ইতিহাসের পাতায় পাল বংশ এবং সেনদের যে রাজত্ব, নবাব সিরাজের যেই অধ্যায়, তার সবই ছিল সেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে মোড়া। পালরা বাঙালি নয়, সেনরা কর্ণাটক থেকে এসে দখল করেছিল এই দেশ। আফগান আলিবর্দির বিদ্রোহ ও রক্তদানের ইতিহাস আছে, কিন্তু কেউই পারেননি বাঙালি জাতির পরাধীনতার শিকল ভাঙতে। এই পরাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছে কবির কবিতায়, শিল্পীর তুলিতে, রাজনৈতিক মাঠ ও ময়দানে। কবি সুকান্ত লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষের উপর গলিত সূর্য ঝরে আজ। দিক-বিদিক উঠছে আওয়াজ/রক্তে আনো লাল/রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনা ফুটন্ত সকাল।’ কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।/… তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন/জয় দেখিয়ে নয়/ সেই ভয়ের টুঁটি ধরবো চেপে/করবো তারই লয়।’
বাঙালি জাতির আরেক অমর সন্তান নেতাজি সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও/আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।’ বাঙালি রক্ত দিয়েছে অকাতরে। জীবন দিয়েছে দীনেশ, বাদল। ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন ক্ষুদিরাম। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছেন মাস্টার দা সূর্যসেন-প্রীতিলতারা। তিতুমীর তৈরি করেছেন বাঁশের কেল্লা। বিদ্রোহ করেছেন নবাব ঈশা খাঁ, শমসের গাজীসহ অগণিত বীর। কিন্তু আসেনি বাঙালি জাতির পরম আরাধ্য স্বাধীনতা। আর বাংলার সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের মুহূর্ত বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিবেদন করেছিলেন। জাতির মুক্তিসংগ্রামে দিয়েছেন নেতৃত্ব। একাত্তরের সাতই মার্চ পাঞ্জাবি-পাঠানের উদ্যত সঙ্গীদের মুখে লাখো জনতার সমাবেশে বলে দিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’
একটি নির্দেশেই মুক্তির উত্তুঙ্গ নেশায় বাংলার দামাল সন্তানরা বুলেট হয়ে ঘর ছাড়ল। নয় মাসের রক্ত¯্রােত পেরিয়ে ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতা। শিকল ভাঙল শত-শতাব্দীর।
সেই মহামানব জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট কাকডাকা ভোরে জাতির কতিপয় কুলাঙ্গার গুলি করে হত্যা করল। ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ল জনকের রক্ত, যেন মুহূর্তে সমগ্র বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইল হয়ে গেল রক্তে রঞ্জিত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জল যেন হয়ে গেল লোহিত বর্ণ।
ওরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। হত্যা করেছে এই জাতির শত শতাব্দীর অর্জনকে, আবহমানকালের বাংলায় লালিত হাজার বছরের সংস্কৃতিকে। হত্যা করেছে ষাট দশকের সব আন্দোলন এবং একাত্তরের রক্তাক্ত-মুক্তিযুদ্ধকে। তারপর ২১ বছরের দীর্ঘ এক কালোরাত শেষে ত্রাতা হয়ে এলেন জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। আবার লড়াই বাঙালি জাতির, আবার সমগ্র জাতিকে একই মোহনায় এনে শেখ হাসিনা হাল ধরলেন এই বাংলার। তাকে হত্যার জন্য বারবার ওরা চালিয়েছে নানামুখী হামলা। ইতিহাসের পাতা থেকে বাঙালি জাতির অজানা কাহিনিগুলোকে তুলে এনে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ।
ভ‚পাতিত পিতা : নিহত শত শতাব্দীর সব অর্জন : যেই মানুষটির জন্ম না হলে বাঙালি জাতির পরাধীনতার শিকল ভাঙত না, যাকে দেখে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো বিশ্বজয়ী কিউবার মহান নেতা বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখিছি।’ সেই মহান নেতাকে জাতির কিছু কুলাঙ্গার গুলি করে ভ‚পাতিত করল। যার হাত ধরে শত-শতাব্দীর বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও দুর্দশা থেকে জাতি মুক্ত হলো, তাকেই ওরা সপরিবারে হত্যা করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শিশির ঝরা প্রাতে।
বিশ্ব ইতিহাসে যেসব নেতা তাদের জাতিকে পরাধীনতার কবল থেকে যুক্ত করেছেন, তাদের সারিতে আছেন জর্জ ওয়াশিংটন, কামাল আতাতুর্ক, আহমেদ সুকর্ণ, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জন অ্যাডামস, প্রেটিস লুমুম্বা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মাও সেতুং, হৌচিমিন, নেলসন ম্যান্ডেলা, আহমেদ বেল বেলাহসহ অগণিত নেতা। এদের সাথে বাঙালি জাতির পিতার তফাত একটাই। ওরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেই মানচিত্রকে স্বাধীন করেছেন। এই উপমহাদেশের টেবিলে মানচিত্র কেটে গান্ধী ও জিন্নাহ হয়েছেন জনক। আর বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেও স্বাধীনতা পানি। তিরিশ লাখ বাঙালির রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা। জীবনের সুকর্ণ দিনগুলোতে সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। যৌবনের দিনগুলো কেটেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি নাম, একটি ইতিহাস : বঙ্গবন্ধুই বলতে গেলে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন সত্তা। যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। যত দিন লাল-সবুজের পতাকা থাকবে, যত দিন এই মানচিত্রে প্রবাহিত হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তত দিন এই মানচিত্রে অমর-অক্ষয় হয়ে রইবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ আন্দোলনরত বাংলার মানচিত্রে সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। সেদিন একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বললেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোতবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিন কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’
দেশকে একদিন মুক্ত করবেনই এমন এক অদম্য স্পৃহা বক্ষে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু সেই অখণ্ড বাংলাতেই শুরু করেন নানামুখী আন্দোলন। নেতাজি সুভাষ বসু, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসসহ বড় বড় নেতার সাহচর্যে থেকে তিনি লালন করতে থাকেন তার এই স্বপ্ন,‘বাঙালি জাতির মুক্তি’। ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও একই লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় তিনি আবার নামেন রাজপথে। পাঞ্জাবি-পাঠানদের দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে সংগঠিত করেন ছাত্রসমাজকে। গঠন করেন ছাত্রলীগ। তার এক বছর পর সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে গঠন করেন আওয়ামী লীগ। শুরু হয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে এক নতুন অভিযাত্রা।
পর্যায়ক্রমে আসে ভাষা আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিতে হলো সেই অন্ধকার কারাগার থেকেই। জেল-জুলুমকে তিনি কোনো দিন পরোয়া করেননি। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে ১৯৫৪ সালেই পূর্ব বাংলার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের ভ‚মিধস পতন ঘটে। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু সেই নির্বাচন পরিচালনা করেন। তরুণ-নবীন বয়সেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন। আবার দলকে সংঘবদ্ধ করার স্বার্থে মন্ত্রিত্ব ছেড়েও দিলেন বঙ্গবন্ধু। এমন নেতা এ দেশে বিরল।
সেই ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, অতঃপর আইয়ুবের সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন। আইয়ুব খান নানা কৌশলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় নেতা সোহরাওয়ার্দীকে বৈরুতের হোটেলে এবং প্রিয় সম্পাদক ইত্তেফাকের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে করাচির হোটেলে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুবের নিয়োগকৃত গভর্নর মোনায়েম খান ঘোষণা করেন, ‘আমি যত দিন গভর্নর আছি তত দিন মুজিবকে জেলে কাটাতে হবে।’
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর নবজাগরণ ঘটে। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট মাথায় নিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের লাহোর অধিবেশনে পেশ করলেন বাঙালি জাতির বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি। ৬৬ সালের ফেব্রæয়ারির ১২ তারিখে এই দাবি পেশের পর তিনি ঝড়ের বেগে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়ালেন। জেলায় জেলায় ওয়ারেন্ট দিয়ে তাকে আটক করে শেষবার আর জামিন দেওয়া হয়নি। ১৯৬৬ সালের মে মাসে তাকে নিরাপত্তা আইনে আবার আটক দেখানো হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। গুলিতে শহীদ হন শ্রমিক ছাত্র-জনতার অনেকে। অতঃপর আইয়ুব শাহী বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুকে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়।
অতঃপর সমগ্র বাংলার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। রোদে পোড়া তামাটে মানুষগুলো নেমে যায় রাজপথে। কেঁপে ওঠে আইয়ুব শাহীর তখতে তাউস। একসময় ভেঙে খান খান হয়ে যায় আইয়ুবের সাজানো মামলা। জনতার মহা আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। ভেসে যায় তার ষড়যন্ত্র মামলা।
আইয়ুব শেষ রক্ষার জন্য ডাকেন গোলটেবিল। তাতে কাজ হয়নি। শেষতক সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। বঙ্গবন্ধু এভাবেই হয়ে গেলেন সমগ্র বাঙালি জাতির ভালোবাসার প্রতিমা।
অতঃপর ৭০ সালের নির্বাচন। যেই নির্বাচননে মাত্র দুটি আসন ছাড়া প্রতিটি আসনে নৌকা প্রতীকের সংসদ সদস্যরা বিজয়ী হন।
আবার টালবাহানা। বাঙালি পাকিস্তান শাসন করবে, এটা মানতে নারাজ পাঞ্জাবি-পাঠান। শুরু হয় আবার ষড়যন্ত্র। আবার সামরিক আগ্রাসন। বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে ঢাকায় আসে জল্লাদ টিক্কা-নিয়াজি-ভুট্টোর দল।
স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন জাতির পিতা। জাতিকে ডাক দিলেন মহাযুদ্ধের জন্য। বলে দিলেন, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে…। বললেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এভাবেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার দামাল ছেলেরা এক উত্তুঙ্গ নেশায় মারণাস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করে।
এই বিজয়ের ইতিহাস সমগ্র বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের সকল ইতিহাসকে মলিন করে দেয়। সেই মুজিব, বাঙালি জাতির তিলে তিলে গড়ে তোলা তিলোত্তমা, সেই মহান নেতাকে ১৫ আগস্ট ভোরে কুলাঙ্গাররা হত্যা করল সপরিবারে। থমকে পড়ল জাতির জয়যাত্রা। অতঃপর ২১ বছরের দীর্ঘ এক কালো রাত, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬। এই ২১ বছর যাবৎ ক্ষমতায় ছিল হত্যাকারী এবং তাদের বেনিফিশিয়ারিরা। ৭৫ সালে তারা জারি করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। মুজিবসহ নিহত ১৭ জনের বিচার কোনো আদালতে করা যাবে না।
জনকের কন্যা ৯৬ সালে ক্ষমতায় বসে সেই ২১ বছরের বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তা থেকে জাতিকে মুক্ত করেন। বাতিল হয় সেই কালো আইন। পর্যায়ক্রমে জাতির সংবিধান এবং ইতিহাস থেকেও তিনি মুছে ফেলেন সামরিক ক্ষতচিত্র।
অনির্বাণ দীপশিখা হাতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।’
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শত্রæর ভেবেছিল মুজিব জেনারেশন ফিনিশ। ১০০ বছরেও আর তাদের নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মহান আল্লাহ পাকের কোরআনের বাণী তো আর মিথ্যা হতে পারে না। মহান আল্লাহর সব কাজ বিল হেকমতে। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার খুন হয়ে গেল, এমনকি গণশত্রুরা শিশু রাসেলকেও রাখল না। বঙ্গবন্ধুসহ ভগ্নিপতি, ভাগনেসহ তাদের নারী-পুরুষ সবাইকে কসাইর মতো নির্মমভাবে হত্যা করল। কিন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা হেকমতেই বাঁচিয়ে রাখলেন জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে। স্বামীর সাথে বোনকে নিয়ে ইউরোপে থাকায় শেখ হাসিনা ও তার বোন বেঁচে রইলেন। ৮১ সালের মে মাসে দেশে ফিরলেন দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর। তারপর ৩৮ বছরের একটানা সংগ্রাম। অনেক বাধাবিঘ্ন এবং সামরিক স্বৈরাচারদের অত্যাচার-নির্যাতন সয়েও জনগণকে নিয়ে পড়ে থাকলেন রাজপথে। ২১ বছরের কালো রাতের অবসান ঘটল। পূর্বাকাশে আবার নতুন সূর্য উদিত হলো। সামরিক স্বৈরাচার, পাকিস্তানি সেবাদাস এবং তাদের বেনিফিশিয়ারিদের পদাতন করে জনতার মহাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ক্ষমতায় বসলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারকে ক্ষমতা দান করি।’ এটা সত্য হয়ে গেল। আল্লাহ পাক সতর্ক করে বলেছেন, ‘হত্যার ব্যাপারে সে যেন সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।’ দেখা গেল ক্ষমতার শীর্ষে বসেও শেখ হাসিনা সীমা লঙ্ঘন করেননি। তিনি এক রাতে তাদের মতো বন্দুকধারী পাঠিয়ে হত্যাকারীদের বিনাশ করেননি, প্রচলিত আইনে বিচার করেছেন। এমনকি ট্রাইব্যুনালও গঠন করেননি। তিনি জানতেন, তিনি মহান আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত। খাদ্য ঘাটতির দেশ, বিদ্যুৎহীন সমগ্র জনপদ, মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ যে দেশের নিয়তি। অধিক জনসংখ্যার কারণে অভাব-অনটন আর বিশ্বব্যাংক এবং দাতাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল এই দেশ।
সেই দেশটিতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্পের মতো জননেত্রী শেখ হাসিনা আমূল বদলে দিলেন। যে দেশকে ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন ‘বটমলেস বাসকেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি’। তখন খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ৯০ লাখ টন। জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। সেই দেশে শেখ হাসিনা চলতি বছরে খাদ্য উৎপাদন করেছেন ৩ কোটি ৮০ লাখ টন; জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটির উপরে। খাদ্য ঘাটতির দেশটি আজ খাদ্য রফতানির দেশে পরিণত হয়েছে। এক বিলিয়নের রিজার্ভ আজ ৩৪ বিলিয়ন হয়েছে। যে দেশে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ আর ৫ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল, সেই ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতাকে শেখ হাসিনা আজ ২০ হাজার মেগাওয়াটে পরিণত করেছেন। শুধু খাদ্যই নয়, রফতানিতে আজ দেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপি ৮-এর ঘর ছাড়িয়েছে। শিল্প-কারখানা, সড়ক-মহাসড়ক, শিক্ষা বিস্তারসহ সব সূচকে দেশ আজ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা বিরান প্রান্তরে হাল ধরেছিলেন, সেই দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ, অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। সে দেশ আজ উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির এক রোল মডেল। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও গণশত্রুর বিরুদ্ধে তার খগড় কৃপাণ যেন ঝলসানো এক তরবারি। লড়ে যাচ্ছেন দুর্নীতি, মাদক ও সমাজবিরোধীদের সাথে। এমন একটি সোনার বাংলা কায়েমের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আজ ইস্পাতকঠিন দৃঢ় প্রত্যয়ে আগুয়ান। শোক আজ মহাশক্তি। দুঃখের অনলে পুড়েছে সব সর্বনাশ, এখন জাতির সামনে শুধুই সমৃদ্ধির আর উন্নয়নের অভিলাষ।